কোটা সংস্কার আন্দোলন
উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে সবাই

কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ অব্যাহত। মঙ্গলবার বুয়েট ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন সমকাল
সমকাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৪ | ০১:১২ | আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৪ | ০৬:৪১
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে রাজপথ ছাড়ছেন না আন্দোলনকারীরা। এক দিন বিরতি দিয়ে আজ বুধবার সকাল থেকেই সর্বাত্মক ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নামবেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি হবে আজ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কোটা প্রশ্নে সব পক্ষের জন্য সম্মানজনক সমাধান সর্বোচ্চ আদালত থেকেই বের হয়ে আসতে পারে। ফলে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর শিক্ষার্থীদের আগামী আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারিত হবে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে কয়েক দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চলছে। এর মধ্যে টানা দু’দিন ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিও পালন করেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল মঙ্গলবার ছিল না বড় কোনো কর্মসূচি। তবে ছাত্র ধর্মঘট, ক্লাস বর্জনের পাশাপাশি কোটার বিরুদ্ধে অনলাইন ও অফলাইনে গণসংযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই গত সোমবার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
অন্যদিকে গতকাল দুপুরে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক যৌথ সভায় কোটা আন্দোলন সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানান ওবায়দুল কাদের।
গতকাল কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি আজ বুধবার নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগের বিশেষ চেম্বার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম। সে ক্ষেত্রে আজ প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হবে।
এবার সকাল-সন্ধ্যা ‘ব্লকেড’
এবার সকাল-সন্ধ্যা ‘ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আজ বুধবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদেশের সড়ক ও রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ‘ব্লকেড’ পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি সড়ক অবরোধ করবেন।
আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা কোটার বিরোধিতা করছি না। আমরা ন্যূনতম কোটার পক্ষে। অনেকেই আমাদের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কিনা– সেটা নিয়ে আলোচনা করছেন। আমরা পরিষ্কার করছি– আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রাখি।
এর আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে ১০ মিনিট মৌন সমাবেশ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
দুই শিক্ষার্থীর আবেদন
কোটা পুনর্বহাল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর করা আবেদন আজ বুধবার আপিল বিভাগে শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চেম্বার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম গতকাল এ আদেশ দেন।
এদিন সকালে আবেদন করার জন্য হলফনামার অনুমতি চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল সাদী ভূঁইয়া ও উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান।
আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হলফনামা করার অনুমতি দেন। অনুমতির পর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনটি করা হলে দুপুরে চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে। আদালতে দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক।
আইনমন্ত্রীর সাধুবাদ
এদিকে কোটা নিয়ে বিচারাধীন মামলায় পক্ষভুক্ত হতে চাওয়া শিক্ষার্থীরা সঠিক পথে হাঁটছেন বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, যেহেতু তারা আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই। আশা করব, তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন। গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি যতদূর জেনেছি, যখন হাইকোর্ট বিভাগে এ মামলা চলে, তখন যারা কোটাবিরোধী আন্দোলন করছেন, তাদের বক্তব্য আদালতের কাছে পেশ করার জন্য কোনো আইনজীবী নিয়োগ করেননি। তাদের বক্তব্য সেখানে দেননি। এর পর মামলাটির রায় হয়ে গেছে; মামলাটি এখন আপিল বিভাগে। সেখানেও সোমবার পর্যন্ত তাদের কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
মন্ত্রী বলেন, ঘটনা ঘটছে আদালতে। রাজপথে আন্দোলন করে এটার নিরসন হবে না। এটা করলে একটা পর্যায়ে হয়তো আদালত অবমাননাও হয়ে যেতে পারে। সঠিক জায়গা হলো, তারা যদি পক্ষভুক্ত হয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অবশ্যই আপিল বিভাগ সব পক্ষের বক্তব্য শুনবেন; একটা ন্যায়বিচার করবেন।
বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ
জাবি প্রতিনিধি জানান, দাবি না মানা পর্যন্ত লাগাতার ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেল পৌনে ৪টা থেকে সোয়া ৪টা পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ চলাকালে এ হুঁশিয়ারি দেন তারা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
রাবি প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্যারিস রোডে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। পরে একই স্থানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা শেষে বিকেল ৪টায় কর্মসূচি শেষ করেন তারা। এ কর্মসূচি শেষে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শোডাউন দেন।
চবি প্রতিনিধি জানান, কোটার বিরোধিতা করে গণসংযোগ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট এলাকার চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধের ঘোষণা দিলেও শিক্ষার্থীরা তা করেননি। গতকাল তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেন।
ঘটনার পরম্পরা
আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওই পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল থাকবে বলে ওই পরিপত্রে বলা হয়।
এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। গত ৫ জুন আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে।
হাইকোর্টের রায়ের পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে নামেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। ১ জুলাই থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে তারা আন্দোলন করছেন।