টেন্ডার ছাড়াই লাখ লাখ কোটি টাকার কাজ

কোলাজ
হাসনাইন ইমতিয়াজ
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪ | ০০:০৮
বাংলাদেশি হলেও সিঙ্গাপুরের ৪১তম ধনী সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের ২০২৩ সালের তথ্য অনুসারে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১১২ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। গত ১৫ বছরে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে সামিট গ্রুপের আয়ও প্রায় একই।
সামিট বিদ্যুৎ ব্যবসায় আসে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ শাসন আমলে। সে সময় একটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্পূর্ণ মালিকানা আর অন্য একটির শেয়ার ছিল সামিট গ্রুপের। এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৮-১০ মেগাওয়াটের কয়েকটি ছোট ছোট কেন্দ্রের মালিক হয় দেশীয় কোম্পানিটি।
তবে ২০১০ সালে বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে দায়মুক্তি দিয়ে বিশেষ বিধান পাস করার পর একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক হতে থাকে সামিট গ্রুপ। বর্তমানে গ্রুপটি দেড় হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক। এর বাইরে একটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে তাদের। এ ছাড়া এলএনজি সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিও পেয়েছে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এ ব্যবসায়ী গ্রুপ।
এসব প্রকল্পে কাজ সামিটকে দেওয়া হয়েছে টেন্ডার ছাড়াই বিশেষ বিধানের আওতায়। এভাবে গত দেড় দশকে চাহিদা না থাকলেও একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দিয়ে শত শত কোটি
টাকা আয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে দলীয় ব্যবসায়ীদের। তাদেরকে সরকারি জমি, কর ছাড়, প্রণোদনা দিয়ে জ্বালানি তেল আমদানিসহ নানা সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
১৫ বছর ধরে এ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের শেষ দুই মেয়াদে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শীর্ষস্থানীয় আবাসন ব্যবসায়ী নসরুল হামিদ। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে গত তিন দফায় দায়িত্ব পালন করেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও ক্ষমতাশালী ছিলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস। এই দু’জনই পরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া পিডিবি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এস এম আলমগীর কবীর, খালিদ হোসেন এবং বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বহুল আলোচিত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর নেপথ্যে ছিলেন তারা।
জানতে চাইলে নবনিযুক্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সমকালকে বলেন, তিনি রোববার অফিস করবেন। এর পর এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবেন।
লাগামহীন বিদ্যুৎ খাত
গত দেড় দশকে সবচেয়ে সমালোচিত ছিল রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প। জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে বেশি দরে তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিতে আনা কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। এসব প্রকল্পের জন্য ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)’ নামে দায়মুক্তির একটি আইন করেছিল সরকার। এই আইনের আওতায় টেন্ডার ছাড়াই বিদ্যুৎ, জ্বালানি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়।
তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি ও সংশোধনের পর ২০২৬ সাল পর্যন্ত এর কার্যকারিতা রয়েছে। এ আইনের আওতায় ৯০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বতর্মানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। যেখানে সর্বোচ্চ উৎপাদন গড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা ছাড়াই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে পিডিবির বোঝা বাড়ানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ কিনতে ব্যয় হয় ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এ সময় বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় অংশই (প্রায় সোয় লাখ কোটি টাকা) গেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে।
সূত্র জানায়, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তিন বছরের মেয়াদে হলেও দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে একাধিকবার সেগুলো সরকারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এসব কেন্দ্রের মোট বিনিয়োগের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারী দেয়। বাকিটা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে মেটানো হয়। পিডিবি তথা সরকার সুদসহ সেই ঋণ (চুক্তি অনুযায়ী) তিন বছরে শোধ করে দেয়। পাশাপাশি ইকুইটি ইনভেস্টমেন্টের ওপর দেওয়া হয় মুনাফা (রিটার্ন অব ইকুইটি)। সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় শোধ করে দিলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটা ওই কোম্পানিরই রয়ে যায়। পরে মেয়াদ বাড়ানো হলেও একই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে আবার নির্মাণ ব্যয় পরিশোধ করা হয়। এভাবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মাধ্যমে লুটপাট করা হয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, এ খাতে কোথায় কত টাকা খরচ করেছে, কত লাভ করছে, তা নিয়ে প্রশ্নও তোলার সুযোগ রাখেনি। আইন করে দায়মুক্তি দিয়েছে।
গত বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বলা হয়েছে, লুটপাট সরকারের গোচরেই হচ্ছে। আর ক্যাপাসিটি চার্জ হচ্ছে ‘লুটেরা মডেল’। এ প্রতিবেদন প্রকাশ করায় আইএমইডির দুই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে।
এলএনজি বাণিজ্য
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ এলএনজি আমদানি শুরু করে। এলএনজি আমদানিতে গত বছরে ভর্তুকি বাবদ ২৬ হাজার ২১৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে গত জানুয়ারি মাসে সংসদে জানিয়েছিলেন সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এই এলএনজি ব্যবসার বড় অংশ সামিট গ্রুপের দখলে। এ ছাড়া কয়েকটি কোম্পানি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সরবরাহ করে, যেগুলোর পেছনে জ্বালানি খাতের দায়িত্বশীল ব্যক্তির যোগসাজশ রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
বেশি দামে কূপ খনন
গত ১০ বছরে গ্যাজপ্রম বাংলাদেশে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ মিলিয়ে ১৭টি কূপ খনন করেছে। কূপপ্রতি রাশিয়ার কোম্পানিটি গড়ে ১৫২ কোটি টাকা
নিয়েছে পেট্রোবাংলার কাছ থেকে। যেখানে
বাপেক্স নিজে কূপ খননে ব্যয় করে সর্বোচ্চ ৮০ কোটি টাকা। ভোলায় আরও দুটি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে গ্যাজপ্রমকে। এখানে বড় ধরনের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এসব কাজ দেওয়া হয়েছে টেন্ডার ছাড়াই।
- বিষয় :
- টেন্ডার