নাবিকের সিডিসি নিয়ে চলছে অনিয়ম

.
অমরেশ রায়
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪ | ০১:০০
নৌপরিবহন অধিদপ্তরে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের অত্যাবশ্যকীয় ‘ধারাবাহিক অব্যাহতিপত্র (সিডিসি)’ নিয়ে চলছে নানা অনিয়ম। অধিদপ্তরের শক্তিশালী সিন্ডিকেট বৈধ ও যোগ্য নাবিকদের সিডিসি দেওয়া থেকে বঞ্চিত করছে। বিপরীতে জাল কাগজপত্র দিয়ে কোনো কোনো নাবিককে বিদেশি জাহাজে কাজ করতে পাঠানো হলেও অযোগ্যতার কারণে চাকরি হারাচ্ছেন তারা। ফলে সব পর্যায়ের বাংলাদেশি নাবিককে বিভিন্ন দেশে অবাঞ্ছিত ও নিষিদ্ধ হতে হচ্ছে। এর ফলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবছর ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স হারাতে হচ্ছে।
তবে ছাত্র আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতন ও নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় আশার আলো দেখছেন বঞ্চিত যোগ্য নাবিকরা। অবিলম্বে এ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি বৈধদের সিডিসি দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন ভুক্তভোগী নাবিকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নৌপরিবহন অধিদপ্তরে সিডিসি নিয়ে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মূল হোতা হচ্ছেন চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। এ কাজে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে আছেন অধিদপ্তরের অধীন চট্টগ্রামের বাংলাদেশ শিপিং অফিসের শিপিং মাস্টার জাকির হোসেন। একটি দালালচক্রের সঙ্গে গভীর সখ্যও রয়েছে গিয়াসউদ্দিনের। এ সিন্ডিকেটই অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রভাব খাটিয়ে বৈধ নাবিককে সিডিসি দিতে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে সরকার অনুমোদিত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাস করা শত শত নাবিক সিডিসি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে তারা বিদেশি পতাকাবাহী কোনো জাহাজে চাকরিও পাচ্ছেন না।
সূত্র বলছে, ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে অযোগ্য এসব নাবিক আফ্রিকার দেশ পানামা থেকে ‘পানামা সিডিসি’ পেয়েছেন বলে দাবি করে বাংলাদেশি সিডিসি নিয়েছেন। বিশ্বের যে কোনো দেশের মেরিটাইম ইনস্টিটিউশনের ডিগ্রি ও সিডিসি থাকলে এর বিপরীতে বাংলাদেশি সিডিসি দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর বাংলাদেশি নাবিকের জন্য পানামা সিডিসি পাওয়া অনেকটা সহজ হওয়ায় এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে গিয়াস-জাকির সিন্ডিকেট। জনপ্রতি আট লাখ টাকা নিয়ে আরামবাগ প্রেসে ছাপানো নকল ‘পানামা সিডিসি’র অনুকূলে গত বছর ১২৭ জনকে অবৈধ পন্থায় বাংলাদেশি সিডিসি দিয়েছে এ চক্র। এ দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় গিয়াসউদ্দিন সিন্ডিকেট।
আবার এসব ভুয়া ‘পানামা সিডিসিধারীরা’ বিভিন্ন শিপিং এজেন্টকে টাকা দিয়ে বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে ওঠার পর ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন বন্দরে গিয়ে পালিয়ে যান। ফলে ওই সব জাহাজ মালিককে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হয়।
এদিকে, ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে নজরুল ইসলাম নামে এক সংক্ষুব্ধ নাবিক এবং বাংলাদেশ সিমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে গিয়াসউদ্দিন ও শিপিং মাস্টার জাকির হোসেনসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট গত ২৭ মে স্পেশাল ব্যাচের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়াকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে বিবাদীদের ওপর রুল জারি এবং তাদের সিডিসি দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ডি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ এ দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দেন। কিন্তু তদন্তের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১২ সালে নিয়োগ পান। গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের বাসিন্দা হওয়ায় তিনি চাকরি পাওয়ার পর থেকেই দোর্দণ্ড প্রতাপে অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে আসছিলেন। ক্ষমতার দাপট দেখাতে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান এবং পুলিশের সদ্য সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) মনিরুল ইসলামের সঙ্গে সখ্যের বিষয়টি ব্যবহার করেন গিয়াসউদ্দিন। গিয়াসউদ্দিনের কারণে বঞ্চনার শিকার হওয়া অনেকেই বিষয়টি সদ্য সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে কয়েক দফায় জানিয়েছিলেন। তবু গিয়াসউদ্দিন সিন্ডিকেটের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে রহস্যজনক কারণে নীরবই ছিলেন সাবেক এই নৌ প্রতিমন্ত্রী।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে কিছুটা বিপাকে থাকলেও নিয়মিত অফিস করছেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। তবে সাংবাদিকদের অনেকটা এড়িয়ে চলছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত দু’দিন গিয়াসউদ্দিনের মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি। এরপর খুদে বার্তা পাঠানো হলেও এর জবাব দেননি।
- বিষয় :
- নৌ পরিবহন অধিদপ্তর