কেউ স্বেচ্ছায় ছাড়ছেন পদ, কাউকে সরাতে জবরদস্তি
পট পরিবর্তনের পর স্কুল-কলেজে বিশৃঙ্খলা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়
সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪ | ০৬:১৮ | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২৪ | ১২:৩৫
রাজধানী ঢাকায় গত দুই সপ্তাহে অন্তত ৪০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পদ ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, আবার কাউকে চাপের মুখে পদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
বরখাস্তও হয়েছেন দু-একজন। নিজের করা দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণেও ফেঁসেছেন তাদের কেউ কেউ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে বাসভবন ছেড়ে প্রধান শিক্ষকের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
পদ হারানো কয়েকজন অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক সমকালকে বলেছেন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগের চেয়ে জবরদস্তির ঘটনাই বেশি। তাদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের আমলে নানা অপকর্মের অভিযোগ আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। অভিযোগ থাকলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়মতান্ত্রিক ও যথাযথ প্রক্রিয়া আছে। তবে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না।
গত ২১ আগস্ট সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, শিক্ষাঙ্গনে বলপ্রয়োগ বা কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত করা যাবে না। যে যত অন্যায় করুক না কেন, নিয়মমাফিক যত দ্রুত পারা যায়, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কলেজের চিত্র
শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে গত ১২ আগস্ট পদ ছাড়েন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ ও উপাধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন। ওই দিন সকালে দু’জনই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন। তবে সরকারি চাকরি হওয়ায় সরাসরি পদত্যাগ করলে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে হবে। এ জন্য তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অন্যত্র বদলির আবেদন করেছেন।
শুধু ঢাকা কলেজ নয়, রাজধানীর আরও তিনটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত ১১ আগস্ট পদ ছাড়েন। তারা হলেন– কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমেনা বেগম, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোহসিন কবীর ও সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফেরদৌস আরা বেগম। সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোহসিন কবীর পদত্যাগের পর শিক্ষার্থীরা বিজয় মিছিলও করেন।
জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইউসুফ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোহসিন কবীর সমকালকে বলেন, আমরা সরকারি চাকরি করি, কোনো দলের নই। তবু শিক্ষার্থীর চাপের মুখে আমরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।
পদত্যাগে বাধ্য হন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী ও কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফারহানা খানম। ১১ আগস্ট ভিকারুননিসার সাবেক ও বর্তমান ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে তারা পদত্যাগপত্র দেন। এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীর দাবির প্রতি সম্মান রেখে আমি পদত্যাগ করছি। আর ড. ফারহানা খানম বলেন, আমাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করানো হয়েছে।
বিদ্যালয়ের চিত্র
১১ থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ১৬ দিনে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস থেকে ৩৬ জন প্রধান শিক্ষকের পদ হারানোর বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। এই ৩৬ জনের মধ্যে পদত্যাগ করেছেন আটজন, পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ২০ জন, পলাতক তিনজন, বাধ্যতামূলক ছুটিতে তিনজন, অপসারিত হয়েছেন একজন এবং আন্দোলনের মুখে বাসভবন ছেড়ে পালিয়েছেন একজন।
ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ বলেন, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি প্রধান শিক্ষকের তথ্য আছে। আমরা মাউশিকে বিস্তারিত জানিয়েছি। পরবর্তী সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানের প্রধান না থাকা বিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সহকারী প্রধান শিক্ষকরা চালিয়ে নিচ্ছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদত্যাগ করা অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকরা হলেন– রাজধানীর খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সরদার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, বনানী মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক কাজী শফিকুল ইসলাম, বিসিএসআইআর স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক ড. মো. ইদ্রিস আলী, রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসনে আরা, নবাবগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুল মান্নান, ঢাকা কটর মিল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুরুল ইসলাম, শ্যামপুর ভাষাপ্রদীপ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইশারত আলী এবং দোহারের জয়পাড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ এস এম আবদুল খালেক।
পদত্যাগ করতে বাধ্য করা অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকরা হলেন– গুলশান মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ এম মুস্তফা জামান মিয়া, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক জোহরা জবীন, মিরপুর নাজনীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. নুরুল ইসলাম, ধামরাই ওদুদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুর রাজ্জাক, কেরানীগঞ্জ কলাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান জামাল, লালবাগ সালেহা উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম, কোতোয়ালি থানার আনোয়ারা বেগম মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রশীদ মোড়ল, একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ কামরুল হাসান মুন্সী, ধামরাই সূয়াপুর নান্নার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ার ইসলাম তালুকদার, এই একই থাকার বাড়িগাঁও কৈলাশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফরহাদ হোসেন, কোতোয়ালি থানার আনন্দময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা বেগম, মিরপুর নিউ মডেল বহুমুখী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আ স ম ফিরোজ, লেক সার্কাস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল, লালবাগ থানার রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহেরুন্নেসা, নতুন জুরাইন কে এম মাঈনুদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মো. আবদুল হাই, বনানী মডেল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, শ্যামপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম, শ্যামপুরের বর্ণমালা আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক খান নাসির উদ্দিন, ডেমরার অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তালুকদার আবদুল মন্নাফ এবং কেরানীগঞ্জের আগানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন।
এর বাইরে অপসারণ করা হয়েছে লালবাগের আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন মুন্সী, বরখাস্ত হয়েছেন ডেমরার মানিকনগর মডেল হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোসা. ফেরদৌসী ইয়াসমিন এবং ছয় মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ডেমরার মান্নান হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম ও মিরপুর মডেল একাডেমির প্রধান শিক্ষক শুভাশীষ কুমার বিশ্বাসকে। আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে বাসভবন থেকে পালিয়ে গেছেন বাড্ডা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন। সরকারি নথিতে এই প্রধান শিক্ষকেক ‘পলাতক’ দোখানো হয়েছে।
এ ছাড়া দোহারের আয়েশা বেগম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ‘খুঁজে যাওয়া যাচ্ছে না’ বলে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসারের নথিতে বলা হয়েছে। তেজগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল মান্নান ২১ আগস্ট প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে ‘নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন’ বলে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসারের এক চিঠিতে মাউশি মহাপরিচালককে জানানো হয়েছে।
অপকর্মেও অভিযুক্ত কেউ কেউ
পদ হারানো প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কেউ কেউ দুর্নীতি ও অপকর্মে জড়িত ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
বাড্ডা গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। তাঁর পদত্যাগ দাবিতে টানা চার দিন আন্দোলন করেন তারা। বিক্ষোভের মুখে গত বুধবার প্রধান শিক্ষক পালিয়ে যান।
স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক জানান, বাড্ডা গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুনের দুর্নীতি ও অত্যাচারের শিকার হয়ে প্রতিষ্ঠানটির সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। প্রধান শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতা ও রোষানলে পড়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে চাকরিচ্যুত এবং প্রাপ্য বেতন-ভাতা থেকে তারা বঞ্চিত।
লালবাগের আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন মুন্সীকে অপসারণ করা হয় গত ১৯ আগস্ট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ দাবিতে ৬ আগস্ট থেকে ছাত্ররা আন্দোলন করে এলেও পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন অধ্যক্ষ মোশাররফ।
সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে ১৯ আগস্ট শান্তিনগর মোড়ে বিক্ষোভ করেন।
খিলগাঁও গভ. স্টাফ কোয়ার্টার হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছেন একই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। এ ঘটনায় খিলগাঁও থানায় মামলাও হয়েছে।
গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার বিসিএসআইআর স্কুল ও কলেজের প্রধান শিক্ষক মো. ইদ্রিস আলীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন শিক্ষকরা। অনিয়ম, নিয়োগ-বাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে অনতিবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেন তারা। ওই দিন বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মো. ইদ্রিস আলী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সীমাহীন দুর্নীতি করে যাচ্ছেন।
বিক্ষোভ হয়েছিল রামপুরা থানার একমাত্র গার্লস স্কুল একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েও। প্রধান শিক্ষক হোসনে আরার পদত্যাগ দাবিতে বিটিভি ভবনের সামনে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ রয়েছে, হোসনে আরা একাডেমিক ভবনের পঞ্চম তলায় ১ হাজার ৬০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বসবাস করতেন, যা অনৈতিক ও নিয়মবহির্ভূত।