ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বিচার প্রশাসনে ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ে অস্থিরতা

বিচার প্রশাসনে ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ে  অস্থিরতা

প্রতীকী ছবি

 আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৩ | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৪:৪২

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে বিচার প্রশাসনে অস্থিরতা চলছে। চাপের মুখে রয়েছেন প্রায় দেড়শ বিচারক। তাদের বেশির ভাগই সুপ্রিম কোর্ট, আইন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় প্রেষণে কর্মরত। এ ছাড়া যারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর মধ্যেই কর্মরত আছেন, তারাও রয়েছেন ব্যাপক চাপের মুখে। ঢাকার বাইরে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকেই এই চাপ আসছে। এ অবস্থায় স্বেচ্ছায় অন্যত্র বদলির প্রস্তাব দিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচারকদের অনেকেই। চলতি মাসে এই বিচারকদের বদলি করার কথা।

ঢাকার বাইরে কর্মরত বিচারকদের দাবি, বিগত সরকারের আমলে বিচার প্রশাসনে ১০-১২ জন বিচারকের নেতৃত্বে ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে ওঠে। মন্ত্রীর অগোচরেও বিচার প্রশাসনে নানা ঘটনা ঘটত। এই সিন্ডিকেট মন্ত্রীকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে। সিন্ডিকেটের কাউকে নামকাওয়াস্তে ঢাকার বাইরে বদলি করা হলেও ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে আবারও একই মন্ত্রণালয় বা সংস্থায় পোস্টিং পেয়েছেন। সুবিধাভোগী ১৪২ জনের তালিকাও তৈরি করেছেন সংক্ষুব্ধ বিচারকরা। সমকাল থেকে পাঁচ পৃষ্ঠার ওই তালিকায় থাকা বিচারকদের কর্মকাল পর্যালোচনা করেও এর সত্যতা মিলেছে। 

বিচারকদের কয়েকজন এই তালিকা আইন উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন বলেও সূত্র দাবি করেছে। তবে এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অবশ্য আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিচার বিভাগ সংস্কারে সরকার কাজ করছে। ইতোমধ্যে আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ কয়েকজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলা অধস্তন আদালতে ২ হাজার ৮১ জন বিচারক কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে ১১২ জন বিচারক গত জুলাই পর্যন্ত প্রেষণে আইন মন্ত্রণালয়, সুপ্রিম কোর্ট, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন, আইন কমিশন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ঢাকা সিটি করপোরেশন, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সারাদেশে শতাধিক বিচারককে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪২ জনের তালিকায় থাকা ১২ জন বিচারকও রয়েছেন। 

বিচারকদের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে বিভিন্নভাবে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর মধ্যে অন্তত ১৪২ জন বিচারক কর্মরত ছিলেন। 
তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আইন মন্ত্রণালয়ে সদ্য সংযুক্ত হওয়া যুগ্ম সচিব (প্রশাসন ১) বিকাশ কুমার সাহা বিভিন্ন পদে প্রায় ২০ বছর ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। মাঝে একবার চট্টগ্রামে বদলি হলেও বছর না ঘুরতেই তিনি আবার ঢাকায় পোস্টিং পান। সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ২০ বছর আইন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রথম সিনিয়র সহকারী সচিব পদে যোগ দেন। এ ছাড়া ১৫ বছরের বেশি সময় ঢাকায় কর্মরত ছিলেন এমন বিচারক ৭ জন। ৪৪ জন বিচারক রয়েছেন, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকায় কর্মরত। ৮ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী জেলায় কর্মরত আছেন আরও ৭৩ জন বিচারক। এর বাইরে ১৭ জন বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিভাগের বাইরে পোস্টিং পান। তবে কয়েক বছর পর তারা আবারও ঢাকায় পোস্টিং নিয়ে পদে ফেরেন।

জানা গেছে, বিচার প্রশাসনে অলিখিতভাবে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল, সেটি মন্ত্রণালয়ের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। এ জন্য বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনকেও ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত ৯ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরপরই জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনে অস্থিরতা দেখা দেয়। ‘ইয়াং জাজেস ফর জুডিশিয়াল রিফর্ম কমিটি’র চাপে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হেলাল উদ্দিনের কমিটি ২১ আগস্ট পদত্যাগ করে। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ঢাকার জেলা জজ পদাধিকারবলে সংগঠনের সভাপতি হন। তবে রিফর্ম কমিটির দাবি নির্বাচিত প্রতিনিধিই হবেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। পরে ওইদিনই চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৪-এর (২৯ আগস্ট তাঁকে চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ পদে বদলি করা হয়েছে) জেলা ও দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, সংগঠনের প্রতিটি পদ গণতান্ত্রিক করতে গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে। জানা গেছে, বিচার বিভাগ সংস্কারের ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টাকে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে। তাদেরই একটি অংশ সিন্ডিকেটসহ সুবিধাভোগী ১৪২ জনের তালিকা তৈরি করেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় বিচার বিভাগীয় এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, প্রেষণে থাকা বা ঢাকায় কর্মরত থাকা কোনো অন্যায় নয়। বিগত সরকারের প্রশাসন যাদের চেয়েছে, তারাই প্রেষণে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বা সংস্থায় কর্মরত আছেন। বর্তমান প্রশাসন না চাইলে থাকার সুযোগ নেই। এটাই বাস্তবতা।

জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্বর্তী কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিব সমকালকে বলেন, ‘তালিকাটা বিষয় নয়। মন্ত্রণালয়ের কাছেই তথ্য রয়েছে, কারা কত দিন ধরে ঢাকায় কর্মরত আছেন। আশা করছি, মন্ত্রণালয় তথ্য পর্যালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।’

আরও পড়ুন

×