ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

কর্মকর্তাদের বাধায় ইউজিসিতে ঢুকতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্যরা

কর্মকর্তাদের বাধায় ইউজিসিতে ঢুকতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্যরা

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভবন (ফাইল ফটো)

সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০:২৩ | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১১:৪৪

চরম অচলাবস্থা বিরাজ করছে উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি)। কর্মকর্তাদের বাধার মুখে অফিসে ঢুকতে পারছেন না কমিশনের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর ও বাকি ৪ সদস্য। তাদের মধ্যে দু’জন সদস্য ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর আর অফিসমুখো হননি। 

কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন ইউজিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের ‘দুর্নীতিবাজ ও নিপীড়নকারী’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগেরও আহবান জানিয়েছেন তারা। 

চেয়ারম্যান ও সদস্যরা কেন অফিস করছেন না জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম এ বিষয়ে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে সমকালের সঙ্গে আলাপে কর্মকর্তাদের বাধা দেওয়ার কথা স্বীকার করেননি কমিশনের দুই সদস্য। একজন বলেন, তিনি ছুটিতে আছেন। অপরজন জানান, তিনি অসুস্থ।

জানা গেছে, ইউজিসিতে একজন চেয়ারম্যান এবং পাঁচজন পূর্ণকালীন সদস্য রয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১ আগস্ট চেয়ারম্যান পদ থেকে অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ পদত্যাগ করেন। তিনি অসুস্থতাজনিত কারণে দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠান।  ইউজিসির পূর্ণকালীন পাঁচ সদস্য হলেন- খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব) এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো কেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেন। 

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ইউজিসি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাবি অনুসারে ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান তুহিনকে সরিয়ে ড. ফখরুল ইসলামকে এ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে, ‘পতিত স্বৈরাচারের দোসর’ হওয়ায় কমিশনের তিনজন সদস্যকে ইউজিসিতে ‘আর মেনে নেওয়া হবে না’ মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারা হলেন- ড. মুহাম্মদ আলমগীর, ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন ও ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ। এমনকি ইউজিসির সংশ্লিষ্ট চালকরাও তাদের অফিসে আনতে আর বাসায় গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন না। 

গত সপ্তাহে ইউজিসি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে, বাকি দুই সদস্য অধ্যাপক হাসিনা খান ও অধ্যাপক মো. জাকির হোসেনকেও ইউজিসিকে আসতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। 

‘আপনারা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন?’ জানতে চাইলে ইউজিসি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মহিবুল আহসান সমকালকে বলেন,

নীতিগতভাবেই তাদের আর ইউজিসিতে আসা উচিত নয়। যেহেতু তারা বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সকলে নিজেদের সম্মান রেখে পদত্যাগ করছেন। নৈতিকভাবে তাদেরও আর এ পদে মানায় না।

তিনি অবশ্য এটাও বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বর্তমান সরকারের একটি আদেশ নিয়ে এসেছেন যে, তিনি পরবর্তী চেয়ারম্যান না আসা পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। বাকি সদস্যরাও যদি এমন কোনো আদেশ নিয়ে আসতে পারেন, আমরা তাদের মেনে নেব। 

সাধারণ সম্পাদক জানান, তাদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, কমিশনে কর্মরত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের যারা নির্ধারিত সময়ে পদোন্নয়ন বা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন তাদের বৈষম্যের দ্রুত অবসান করে নিজ অবস্থান নিশ্চিত ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতো ভূতাপেক্ষভাবে তা দিতে হবে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইউজিসি ভবনে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কারও দেখা মেলেনি। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, ৫ আগস্টের আগে থেকেই দুই সদস্য সাজ্জাদ হোসেন ও বিশ্বজিৎ চন্দ অফিসে আসা ছেড়ে দিয়েছেন। ৫ আগস্টের পরে তারা গা ঢাকা দেন। মুহাম্মদ আলমগীর, জাকির হোসেন ও হাসিনা খান মাঝেমধ্যে হঠাৎ ঘণ্টাখানেকের জন্য আসতেন। জরুরি কাজ সেরে চলে যেতেন। ইউজিসি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত জানানোর পর তারা তিনজনও আর অফিসে আসছেন না। তবে বুধবার কিছুক্ষণের জন্য অফিসে এসে ইউজিসির অর্থ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য হিসেবে মো. জাকির হোসেন ইউজিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগস্ট মাসের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত নথিতে স্বাক্ষর করে যান। 

জানা গেছে, অফিসে না এলেও কমিশনের সদস্যদের কেউ কেউ ডি-নথিতে (ডিজিটাল নথি) সই-স্বাক্ষর করছেন। আর দুজন সদস্য আত্মগোপনে আছেন। কাজী শহীদুল্লাহর পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন মুহাম্মদ আলমগীর। তবে ২৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাকে পুনরায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ায় তিনি ই-ইমেল করে তার যোগদানপত্র ইউজিসিতে পাঠিয়েছেন। কর্মকর্তাদের বাধার মুখে ইউজিসিতে আসতে না পারলেও তিনি রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার বাসা থেকেই সকল ডি নথিতে স্বাক্ষর করছেন। 

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ইউজিসির চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে সব সময়ই সরকারের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমান কমিশনের সকলেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দফায় দফায় নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আলমগীর আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের আট বছরই কুয়েটের ভিসি ছিলেন। এরপর টানা চার বছর ইউজিসির সদস্য ছিলেন। ১২ বছর পার করে দ্বিতীয় দফায় আবারও ইউজিসির সদস্য পদে আরও চার বছরের জন্য নিয়োগ পান। বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদ পার করছেন। তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির দূরসম্পর্কের আত্মীয়। 

এদিকে কুয়েটর প্রাক্তন ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীরকে ইউজিসি চেয়ারম্যান থেকে অপসারণের দাবিতে এবং ভিসি থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। বুধবার দুপুরে কুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কুয়েটের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়।

সদস্য সাজ্জাদ হোসেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন বিআইআইটি) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, তিনি ইউজিসিতে এসে নানা মাত্রায় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নিজের পছন্দের কয়েকটি আইটি ফার্মকে ঠিকাদারি কাজ দিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ওপর অযাচিত চাপ সৃষ্টি করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ওপর ২০২১ সালের ৯-১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের নামে ইউজিসির সকল রীতিনীতি ভেঙে তিনি বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করেন। ইউজিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি কখনও নিজস্ব অর্থের বাইরে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউজিসিতে এই সদস্যদের নিয়োগও আইনানুগ হয়নি। ইউজিসি আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদস্য পদে নিয়োগের কোনো বিধান না থাকলেও বিগত সরকারের আমলে তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ইউজিসির সদস্য পদে থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ‘এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ’ (ইআরডিএফবি) নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সকলকে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য সারাদেশে ‘গো ফর ভোট’ ক্যাম্পেইন চালান। 

অফিসে না যাওয়া ও দুর্নীতির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাজ্জাদ হোসেন সমকালকে বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এখন অনেকে অনেক কথাই বলবে। আমি অফিসে যাই না, কারণ আমি ছুটিতে আছি। পারিবারিকভাবে সময় কাটাচ্ছি। তিনি বলেন, আমি খুব দুঃখ পাই, বিদেশে পড়ালেখা করেছি, সেখানেই ছিলাম। ১৬ বছর আগে দেশে এসেছি এ দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য। এখন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কী করব জানি না। তবে আমি অফিসে যাব। 

ইউজিসির অপর সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ সদ্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের ছেলে। তার বাবা বর্তমানে গা ঢাকা দিয়ে আছেন বলে ইউজিসিতে আলোচনা আছে। 

জানা গেছে, ইউজিসির এই সদস্যের দুই গাড়ি চালক সেলিম ও তানভীর মোল্লা সম্প্রতি মিরপুরে ইউজিসির আবাসিক কোয়ার্টারে দামি দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি লুকিয়ে রাখেন। সেলিম ঢাকা মেট্রো-গ-৩৫-৩২০০ এবং তানভীর মোল্লা ঢাকা মেট্রো-গ-৪২-৩২৩৭ নম্বরের গাড়ি দুটি কয়েক দিন লুকিয়ে রাখার পর ইউজিসির কর্মকর্তাদের আপত্তির মুখে গাড়ি দুটি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যান। তাদের জেরার মুখে চালক তানভীর মোল্লা দাবি করেন, গাড়িটি তিনি কিনেছেন। প্রশ্ন ওঠে- স্বল্প বেতনের একজন গাড়ি চালক কি করে এতো দামি গাড়ি কিনতে পারলেন? সংশ্লিষ্টরা জানান, গাড়ি দুটি মূলত অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বেনামে কিনেছেন।

সমকালের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ জানান, তিনি অসুস্থ, ডেঙ্গু হয়েছে। ২২ থেকে ২৭ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এখনও অসুস্থ। তাই অফিসে যাচ্ছেন না।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইউজিসির অপর সদস্য ড. হাসিনা খান মূলত বিজ্ঞানী ও খ্যাতনামা গবেষক। তিনি ইউজিসির প্রশাসনিক কার্যক্রম সেভাবে উপভোগ করছিলেনও না। তাঁর ঘনিষ্টরা জানান, তিনি পদত্যাগপত্র প্রস্তত করে রেখেছেন। সহকর্মীরা সিদ্ধান্ত নিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই পদত্যাগ করবেন।  

আরও পড়ুন

×