শহীদী মার্চ
‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মাসপূর্তিতে ছাত্র-জনতার মিছিল
সমকাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২২:২১
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পূর্তিতে সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘শহীদী মার্চ’ কর্মসূচিতে সব স্তরের মানুষের ঢল দেখা গেছে। কর্মসূচিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার পাঁচ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এগুলো হলো গণহত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা, শহীদ পরিবারদের আর্থিক ও আইনি সহযোগিতা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রদান করা, প্রশাসনে দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে বিচারের আওতায় আনা, গণভবনকে ‘জুলাই স্মৃতি জাদুঘর’ ঘোষণা করা এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রোডম্যাপ দ্রুত ঘোষণা করা।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তভেজা অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এ উপলক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে মার্চ শুরু হয়। সেখান থেকে জনতার ঢল নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, কলাবাগান, মিরপুর রোড ধরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ হয়ে সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও রাজু ভাস্কর্য হয়ে আট কিলোমিটার পথ হেঁটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়। এ সময় প্রতিটি মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে অবস্থান নিতে দেখা যায় জনতাকে। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বাংলামটর মোড়ে মার্চে অংশগ্রহণকারী জনতাকে স্বাগত জানান স্থানীয় দোকানপাট ও বাসার মানুষ।
এ সময় ছাত্র-জনতা ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধর রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘বিচার চাই বিচার চাই, খুনি হাসিনার বিচার চাই’, ‘আমাদের শহীদেরা, আমাদের শক্তি’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। ‘জনবান্ধব সংবিধান চাই, যতবার ফ্যাসিজম ততবার সংগ্রাম’ ইত্যাদি লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখায়।
কর্মসূচিতে সারজিস আলম বলেন, জনতার জনসমুদ্র প্রমাণ করে দিয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের স্পিরিট এ বাংলাদেশে নিশ্চুপ হতে পারে না। এই চেতনা শেষ হওয়ার নয়। যারা ফ্যাসিস্টের চেতনা বিন্দুমাত্র ধারণ করে, তাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, স্বাধীন দেশে নতুন করে ফ্যাসিস্টের দোসর সাজার চেষ্টা করবেন না। কেউ এমন চেষ্টা করলে এসব ফ্যাসিস্টের একসঙ্গে প্রতিহত করবে ছাত্র-জনতা। কোনো চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটকারীর অবস্থান এই বাংলাদেশে হবে না। তিনি বলেন, আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধরে রাখতে যে কোনো দিন যে কোনো সময় আমরাও রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকব।
সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, বিপ্লব-পরবর্তী দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। স্পিরিট থেকে আমরা বিচ্যুত হব না। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আজকের শহীদী মার্চে ৫ আগস্টের পুনর্জাগরণ হয়েছে। যারা বলেছে জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে, ছাত্রদের মধ্যে বিভাজন দেখা গেছে; এ বিভাজন কাজে লাগিয়ে তারা টেন্ডারবাজি-সিন্ডিকেট করতে পারবে তাদের জন্য এ পদযাত্রাই আমাদের বার্তা।
দুর্নীতি দূর করার দাবি গণমানুষের: শহীদী মার্চে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়। শহীদ মিনারে কথা হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিউবিটি) শিক্ষক আসলাম হোসেনের সঙ্গে। তিনি তাঁর সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে রাইসা নূরকে নিয়ে মিরপুর থেকে এসেছেন।
তিনি সমকালকে বলেন, ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। শহীদদের মর্যাদায় ছাত্র-জনতার উদ্দীপনার অংশ হতে এখানে এসেছি। বিগত বছরগুলোতে আমরা সব সেক্টরে লাগামহীন দুর্নীতি দেখেছি। আমার চাওয়া, স্বাধীন বাংলাদেশ যেন দুর্নীতিমুক্ত হয়। মানুষের মর্যাদা যেন সুরক্ষিত থাকে। পাচার হওয়া টাকা যেন ফেরত আনা হয়, অর্থনীতি যেন দ্রুত সচল হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সৈয়দা কানিজা বলেন, আমরা চাই দেশ অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। মানুষ হিসেবে সবার অধিকার-মর্যাদা রক্ষিত হবে। পড়াশোনার মানোন্নয়ন করতে হবে।
বারিধারার জামিয়া মাদানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাদ পালোয়ান বলেন, অর্জিত স্বাধীনতা যেন আমরা রক্ষা করতে পারি, আমাদের সবার মধ্যে যেন ঐক্য বজায় থাকে।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজ মাঠে শহীদী মার্চ কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে, নতুন সরকারের উপদেষ্টাদের আরও তৎপর হয়ে আহত-নিহতদের তালিকা তৈরির আহ্বান জানান শিক্ষার্থীরা। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান তারা।
নিহতদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে গতকাল বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) আট নম্বর গেটের সামনে দোয়া ও মোনাজাত করেন ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর আগে এনএসইউর সামনে থেকে একটি র্যা লি বের করা হয়। পরে সমাবেশ ও মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় অনুষ্ঠান। সমাবেশে বক্তব্য দেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিপন চৌধুরী, তপু, নিখিল, মাশরাফি, ওয়ালিদ, সৌরভ, শিহাব, সাদমান, সালমান প্রমুখ।