ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সেনাবাহিনীর তদন্তের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র

সহযোগিতা করেন সেনা কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র

ফাইল ছবি

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৪

শুধু অপারেশন ডাল-ভাত বা রেশন বৃদ্ধির জন্য পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। এর পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। এটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা, যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে দুর্বল করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য বানানোর অভিসন্ধি ছিল। এই পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল দেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক। যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার ক্ষেত্র অনেক আগেই তৈরি করা হয়। অসন্তোষ তৈরির জন্য সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু গুজব ছড়ানো হয়েছিল।

গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মেজর জেনারেল (অব.) প্রকৌশলী আবদুল মতিন। তিনি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কারণ নির্ণয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানাতেই ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। 

লিখিত বক্তব্যে আবদুল মতিন বলেন, পিলখানার ঘটনায় অনেকে চাকরি হারান, অনেকে পদোন্নতিবঞ্চিত হন। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনা হলে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পাওয়া নতুন স্বাধীনতা মুখ থুবড়ে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালের ১৭ বা ১৮ ডিসেম্বর ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বাসায় বিডিআর সদস্য হাবিলদার মনির, সিপাহি শাহাবসহ কয়েকজন বৈঠক করেন। নির্বাচনের আগে সুবেদার তোরাব আলীর নেতৃত্বে স্থানীয় একটি নির্বাচনী কার্যালয়ে আরেকটি বৈঠক হয়। সেখানে ব্যারিস্টার তাপসকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বিনিময়ে বিডিআর সদস্যদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দেন তিনি। নির্বাচনের আগে ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পিলখানার দরবার সংলগ্ন মাঠে কয়েকজন সিপাহি ও বেসামরিক ব্যক্তি তাদের দাবির বিষয়ে আলোচনা করেন। নির্বাচনের কয়েক দিন পর জিগাতলায় তাপসের নির্বাচনী কার্যালয়ে আবারও দাবি নিয়ে আলোচনা হয়। 

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের আগে ২০০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে বনানীতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বাসায় বিডিআরের তৎকালীন ডিএডি হাবিব ও জলিল, ল্যান্স নায়েক রেজাউল, হাবিলদার মনির, সিপাহি সেলিম, কাজল, শাহাবউদ্দিন, একরাম, আইয়ুব, মঈন, রুবেল, মাসুদ, শাহাদত ও জাকির বৈঠক করেন। তখন শেখ সেলিম দাবিগুলো লিখিত আকারে দেওয়ার কথা বলেন এবং বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে দাবি আদায় করা হবে। ১৮ ফেব্রুয়ারি জাকিরের কোচিং সেন্টারে একটি বৈঠক হয়। সেখানে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া বিডিআর সদস্য এবং কিছু অসামরিক ব্যক্তিসহ ১০-১২ জন উপস্থিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি কিছু লিফলেট পাওয়া যায়। এর আগে-পরেও বিডিআর সদস্যদের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়। সুবেদার গোফরান মল্লিক নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) দরবার হলে আক্রমণের পর বাহিনীর মহাপরিচালক সেনাপ্রধান ও র‍্যাব মহাপরিচালককে কল করেন। তারা সবাই যাওয়ার আশ্বাস দিলেও কেউ যাননি। সেনাবাহিনী থেকে দুটি ব্যাটালিয়ন পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের আক্রমণ চালাতে দেওয়া হয়নি। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া ৪৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ভাগনে। মেজর জাঈদীর ভূমিকাও একই রকম রহস্যজনক ছিল।

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক সেনা কর্মকর্তারা বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই ঘটনায় সহযোগিতা করেছেন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তার ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। এ ঘটনার সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ কিছু সেনা কর্মকর্তার সহযোগিতা ছিল। তাদের মধ্যে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদ। তখনকার প্রতিরক্ষা সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা প্রত্যেকে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের একটি দলকে বিমানে করে বিদেশেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন (প্রয়াত), জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, সোহেল তাজ এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধেও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

সেনা তদন্ত কমিটি নানা রকম বাধার মুখে পড়ে, অনেক সংস্থা সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে এবং অনেক প্রমাণ নষ্ট করা হয় বলেও অনুষ্ঠানে জানানো হয়। 
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোরশেদুল হক, কর্নেল (অব.) আবদুল হক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আমিনুল ইসলাম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ কামরুজ্জামান প্রমুখ।


 

আরও পড়ুন

×