ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

মুনাফা বোনাসের নামে হাজার কোটি টাকা ভাগাভাগি

মুনাফা বোনাসের নামে হাজার কোটি টাকা ভাগাভাগি

.

 হাসনাইন ইমতিয়াজ

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:৩৯ | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০:৫০

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানিগুলো গত দেড় দশকে মুনাফা (প্রফিট) বোনাসের নামে ভাগাভাগি করে নিয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকার যখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে, তখন মুনাফা বোনাস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। 

কোন কোম্পানি কত টাকা মুনাফা করেছে এবং মুনাফা বোনাস হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কত টাকা পেয়েছেন, সেই তথ্য দ্রুত সংগ্রহ করতে বুধবার সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বার্ষিক আয় ও মুনাফার বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে শিগগিরই প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হবে।  

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রতিবছর বিপুল অর্থ লোকসান দেখায়। অথচ এর অধীন কোম্পানিগুলো বছর শেষে লাভ দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ‘মুনাফা বোনাস’ নামে ভাগাভাগির এই অর্থের অঙ্কটা বছরে কমবেশি ১০০ কোটি টাকা। 

শুধু মুনাফা বোনাস নয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অযাচিত অর্থ খরচে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করার অভিযোগ রয়েছে। অনেক কোম্পানি কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচতারকা হোটেলে এজিএম করেছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থা পিডিবি লোকসান দেখিয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এই সময়ে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। ভর্তুকির পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে লোকসান কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গত ১৬ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরায় ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ গ্রাহকের জন্য বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ১৮৮ শতাংশ।

২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয়েছে ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে সরকারি পাঁচটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি নিট মুনাফা করে ১ হাজার ৫১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর ৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুনাফা বোনাস হিসেবে দাঁড়ায় ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। যে কোম্পানি যত বেশি লাভ করে, তার কর্মীরা তত বেশি মুনাফা বোনাস পান। লাভের অনুপাতে বছরে ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বোনাস পেয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোও একই কাজ করছে। কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি (কেজিডিসিএল) ২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ লাখ টাকা করে বোনাস দেয়। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) থেকে আয় করা ২ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা পেট্রোবাংলাকে দেয়নি কেজিডিসিএল। নিজেদের লাভ দেখিয়ে বছর শেষে বোনাস নিয়েছেন এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অথচ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে, বিতরণ চার্জ বাদে গ্যাস বিক্রির সব আয় পেট্রোবাংলাকে দেওয়ার কথা। কিন্তু ২০১০ সালে কেজিডিসিএল গঠনের পর থেকে একবারও তা হয়নি। 

কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা জানান, শ্রমিক আইন অনুযায়ী, কোম্পানির বার্ষিক মুনাফার ৫ শতাংশ বোনাস হিসেবে তারা পান। তবে লোকসানে থাকা বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের জন্য আইনটি কতটা প্রযোজ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। 

বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, আইনটি হয়েছিল মূলত গার্মেন্ট শ্রমিক ও বেসরকারি শিল্পকারখানার শ্রমিকদের জন্য। আইনে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বোনাসের আওতায় রাখা হয়নি। শোষণ কমাতে মালিকদের লাভের একটা অংশ শ্রমিকদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। পিডিবি, পেট্রোবাংলা ও বিপিসি ঋণে জর্জরিত। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলো কী করে লাভ করে?’ রাষ্ট্রের টাকা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সবাই এক বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

আরও পড়ুন

×