ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সেই অক্টোবরের স্মৃতি-২

সুজাতাদের মলিন স্মৃতিচিহ্ন

সুজাতাদের মলিন স্মৃতিচিহ্ন

ভোলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ফাতেমাবাদ গ্রামের এই বাড়িতেই থাকতেন সুজাতারা। বাড়িটি কিনে নিয়েছেন জনৈক লালু মাঝি-সমকাল

রাজীব নূর, ভোলা থেকে ফিরে

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০১৯ | ১৭:২৮ | আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৯ | ১৭:৪২

'হিন্দুবাড়িতে প্রতি দিনান্তে গৃহকর্ত্রী তুলসীগাছের তলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়, গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে। আজ যে-তুলসীগাছের তলে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সে-পরিত্যক্ত তুলসীগাছের তলেও প্রতি সন্ধ্যায় কেউ প্রদীপ দিত। আকাশে যখন সন্ধ্যাতারা বলিষ্ঠ একাকীত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তখন ঘনায়মান ছায়ার মধ্যে আনত সিঁদুরের নীরব রক্তাক্ত স্পর্শে একটি শান্ত-শীতল প্রদীপ জ্বলে উঠত প্রতিদিন।'

সুজাতাদের বাড়িতে পা রাখতেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'একটি তুলসীগাছের কাহিনী' গল্পটি মনে পড়ল। যদিও ওই বাড়িতে গিয়ে তুলসীগাছটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষ্ণুপ্রিয়া দাস ও তার পুত্রবধূ সুজাতা দাস লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ফাতেমাবাদ গ্রামের যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে যাওয়ার আলপথ থেকেই দেখা যায় জবা ফুলের একটি গাছ। আঙিনায় পা রাখতে চোখে পড়ল অযত্নের মধ্যেও গাঁদা ফুলের কয়েকটি চারা সুজাতাদের মলিন স্মৃতিচিহ্ন হয়ে টিকে আছে। হিন্দুদের পূজার উপাচার হিসেবে এই ফুলগুলো লাগে। ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের হিন্দু বসতিতে আবাস গড়া মুসলমানদের বেশিরভাগই এই গাছগুলো উজাড় করে দিয়েছে। সুজাতাদের বাড়ির নতুন মালিক লালু মাঝি একটু ব্যতিক্রম। জানালেন, 'এগাইন (এইগুলো) হিন্দুগো স্মৃতি। রাখি দিছি আঁই (আমি)।' তুলসীতলাটি কোথায়- জানতে চাইলে লালু বললেন, 'মরি গেছে। যত্ন না হাইলে (পেলে) তো তুলসীগাছ বাঁচে না। যাদব-মাধবরা যতদিন আছিল, ততদিন গাছটাও বাঁচি আছিল (বেঁচে ছিল)।'

সুজাতার স্বামীর নাম যাদব দাস। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরদিন রাতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন যাদবের স্ত্রী সুজাতা ও মা বিষ্ণুপ্রিয়া। সুজাতা তখন ছিলেন কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শাশুড়ি ও পুত্রবধূ ধর্ষণের ওই ঘটনা প্রায় দেড় মাস পর গণমাধ্যমে আসে। এরপর ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পুলিশ বাধ্য হয়ে মামলা নেয়। সুজাতা বাদী হয়ে ওই মামলায় কালাম, হারুন, মোতাহার, নান্টু ও আলমগীর নামে পাঁচজনকে আসামি করেন। বাড়িঘর লুটের মামলায় বাদী হয়েছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া।

ওই মামলার কী হয়েছিল, কারোর জানা নেই। লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মিয়াও ভালো করে জানেন না বিষয়টি। তিনি বলেন, 'খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি ওই মামলায় ঘটনার পরপরই আলমগীর ও নান্টু ওরফে নান্নু গ্রেপ্তার হয়েছিল। এই দু'জন বছরখানেক হাজত খেটেছে। বাকিরা ছিল পলাতক। পরে মামলাটিই খারিজ হয়ে যায়।'

বৃদ্ধা বিষ্ণুপ্রিয়া ও সন্তানসম্ভবা মা সুজাতা ধর্ষিত হওয়ার ওই ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। এতকাল পর লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে তাদের খুঁজতে গিয়ে তারা কোন গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তা মনে পড়ছিল না। রায়চাঁদ উদয়চন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক হীরালাল ভৌমিক ফাতেমাবাদ গ্রামে গিয়ে খোঁজ করার পরামর্শ দিলেন। ফাতেমাবাদের পথে পথে খোঁজ করেও হদিস মিলছিল না সুজাতাদের। অবশেষে এক মহিলা দেখিয়ে দিলেন প্রফুল্ল হালদারের বাড়ি।

বাড়িতেই ছিলেন প্রফুল্ল। হাত তুলে দেখালেন ওই বাড়ি। তার বাড়ির পেছন দিক থেকে সুজাতাদের বাড়িটি দেখা যায়। তবে ওদিক দিয়ে যাওয়ার পথ নেই বলে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। প্রফুল্ল হালদারের কাছে প্রথমবারের মতো জানা গেল, সুজাতারা চলে গেছেন দেশ ছেড়ে। কোথায় গেছেন তা তার জানা নেই বলে জানালেন। তারপর বললেন, 'ক্রান্তির চর অথবা চর টাকিমারির কোথাও হবে। জলপাইগুড়ির গজলডোবা এলাকার ওই চরগুলোই বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া গরিবের আশ্রয়।'

প্রফুল্ল হালদার যে কোনো দিন নিজেও চলে যাবেন বলে জানালেন। অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই বলে গেলেন, ১৯৯২ সালের 'ঘরপোড়া দাঙ্গা'র পর থেকে মন ওঠে গেছে তার। তখন ফাতেমাবাদ গ্রামের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত সবটাই ছিল হিন্দুদের বসতি। সেবার ভয় পেয়েছিলেন খুব। তখনই পরিবারের সবাইকে পাঠিয়ে দেন। না পাঠালে বিষ্ণুপ্রিয়া ও সুজাতার মতো তার ঘরেও কেউ না কেউ ধর্ষণের শিকার হতো ২০০১ সালের 'বেইজ্জতির দাঙ্গা'য়। অনেক চেষ্টা করে জমিজমা বিক্রি করতে পারেননি। দেশের মায়াও ছাড়তে পারছেন না। তাই রয়ে গেছেন।

১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে 'ঘরপোড়া দাঙ্গা' এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর নেমে আসা নির্যাতনকে তারা 'বেইজ্জতির দাঙ্গা' বলে থাকে। ১৯৯২ সালে অনেক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০০১ সালে ধর্ষিত হয়েছেন অনেক নারী। দু'বারই হিন্দুদের বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়েছিল।

জমি বিক্রি করতে পারেননি কেন- জানতে চাইলে প্রফুল্ল হালদার বলেন, 'হিন্দুর জমি সবাই পানির দামে কিনতে চায়। তাছাড়া নদী এগিয়ে আসায় কমছে জমির দাম।' ফাতেমাবাদ গ্রামের ভেতর দিয়ে একটি নদী বইয়ে গেছে। খালের মতো ছোট এই নদীটির নাম বেতুয়া। গ্রামের অদূরেই রয়েছে প্রমত্তা মেঘনা। এই এলাকায় মেঘনা অনেক ভাঙনপ্রবণ।

বছর পাঁচেক আগে সুজাতাদের বাড়িটি কিনে নিয়েছেন যে লালু মাঝি তিনি একজন নদীভাঙা মানুষ। একদা তাদের বাড়ি ছিল তজুমদ্দিনের মির্জাকালু এলাকায়। তবে তারও আগে তার পূর্বপুরুষের বাস ছিল নোয়াখালীতে। ভোলার তজুমদ্দিন ও লালমোহন এলাকার বেশিরভাগ মানুষেরই পূর্বপুরুষ নোয়াখালী অঞ্চলের। তাদের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে বরিশালের তুলনায় নোয়াখালীর মিল বেশি। মির্জাকালুর বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর লালু মাঝি এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন লালমোহনের আবাসনে। নদীভাঙনে উদ্বাস্তু মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রকে বলা হয় আবাসন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের গড়া আশ্রয়কেন্দ্রকে বলে গুচ্ছগ্রাম। বাস্তুহারাদের মধ্যে যারা একটু প্রভাবশালী সাধারণত তারা ঠাঁই পায় আবাসনে। লালু মাঝির পেশা মাছ ধরা। তবে সাধারণ পাঁচজন জেলের চেয়ে তিনি বিত্তবান, সেটা তার বাড়ির সামনের জালগুলো দেখেই ধারণা করা যায়। সুজাতাদের স্মৃতিচিহ্ন মলিন হয়ে গেলেও তাদের দোতলা টিনের ঘরটিতে নতুন রং দিয়েছেন লালু মাঝি। দূর থেকেই চোখে পড়ে নীল রঙের ছটা।

লালু মাঝি জানান, যাদবরা জমি বিক্রি করে দেওয়ার পর বছরখানেক ছিলেন এই বাড়িতে। তিনি ওদের থেকে যেতেই বলেছিলেন। তবু ওরা চলে গেল। লালু মাঝি বলেন, 'মাইনষে কিল্লাই (কেন) দেশ ছাড়ে? সহজে ত কেউ বিদেশ যায় না। যাদবের বউ যন বেইজ্জত হইছিল তন (তখন) হেতির হেডে (তার গর্ভে) যে মাইয়াটা আছিল হেতি অন ডাঙ্গর অইছে (সে এখন বড় হয়েছে)। এই দেশে থাইকলে মাইয়াটার বিয়াশাদি লই বিপদে হড়ন (পড়া) লাইগত।'

আরও পড়ুন

×