ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

এগিয়ে অগ্রসর শিক্ষার্থীরা দুর্বলরা আরও পিছিয়ে

ফল বিশ্লেষণ

এগিয়ে অগ্রসর শিক্ষার্থীরা  দুর্বলরা আরও পিছিয়ে

ফাইল ছবি

 সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৪৯

অর্ধেক পরীক্ষা, অর্ধেক সাবজেক্ট ম্যাপিং। অন্যরকম এক ফল। এবারের উচ্চ মাধ্যমিকে অগ্রসর শিক্ষার্থীরা আরও এগিয়ে গেছেন; দুর্বলদের অবস্থান আরও দুর্বল হয়েছে। ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে, গতবারের চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০টি ও পরীক্ষাকেন্দ্র বেড়েছে ৩৮টি। ১ হাজার ৩৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাই পাস করেছেন। তবে ছাত্রদের চেয়ে ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি পাস করেছেন ছাত্রীরা। এ ছাড়া ১৫ হাজার ৯৫৫ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ অর্জন করেছেন। গত এক দশক ধরেই তাদের সাফল্যের এ ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
একদিকে কমেছে পাসের হার, অন্যদিকে সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫-এর উল্লম্ফন।

 দ্বিমুখী এবারের এইচএসসির ফলে। আর এর নেপথ্যে কাজ করেছে ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’। মেধাবী শিক্ষার্থীরা আরও ভালো ফল করেছেন, অন্যদিকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা এবারও পিছিয়ে পড়েছেন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, আগের পাবলিক পরীক্ষায় ফল খারাপ করা ছাত্রছাত্রীদের পরের পরীক্ষায় পরিশ্রম বেশি করে ফল ভালো করার সুযোগ থাকে। তবে পরীক্ষা না হলে, আগের পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করার কারণে পিছিয়ে পড়ারা আরও পিছিয়েই পড়ে। এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলেও তাই হয়েছে।

২০২৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার পরীক্ষার্থীরা তাদের সব পরীক্ষা শেষ করতে পারেননি। মোট ১৩টি পত্রের মধ্যে সাতটি পত্রের পরীক্ষা দিয়েছিলেন তারা। দেশে বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন করে পরীক্ষার রুটিন ঘোষণা করলেও একদল শিক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে বাকি পরীক্ষা না দেওয়ার দাবি জানান। সরকার সেই দাবি মেনে বাকি ছয়টি পরীক্ষা বাতিল করে। এই ছয়টি পত্রের পরীক্ষা এসএসসি ও সমমানের বিষয়গুলোর প্রাপ্ত ফলের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে মাধ্যমিকে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের ফল এবারও ভালো হয়েছে। এক লাফে ৫৪ হাজারের বেশি বেড়েছে জিপিএ ৫। 

অন্যদিকে, মাধ্যমিকে আশানুরূপ ফল করতে না পারা ছাত্রছাত্রীদের ফল এবারও মনঃপূত হয়নি। ‘অর্ধেক পরীক্ষা, অর্ধেক সাবজেক্ট ম্যাপিং’ পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ করায় মেধাবীরা লাভবান হয়েছেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা আর ভালো করতে পারেননি।

দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের পুরো সুযোগ এবার লাভ করেছেন মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা। বিশেষ করে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে থাকা ছাত্রছাত্রীরা, যারা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এসে গ্রুপ পরিবর্তন করে ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিক শাখায় এসেছেন, তারা বেশি লাভবান হয়েছেন। বিজ্ঞানের বিষয়ে ব্যবহারিক ও অন্যান্য কারণে নম্বর বেশি মেলে। তাই এসএসসিতে বিজ্ঞানে থাকা শিক্ষার্থীরা এবার বেশি এগিয়ে গেছেন। 
এবারের এইচএসসি পরীক্ষা যখন শুরু হয়, তখন সিলেট অঞ্চলে ছিল বন্যা। পরীক্ষার্থীদের বড় অংশের ঘরবাড়ি প্লাবিত, বই-খাতা নষ্ট হয়েছে। ফলে সিলেট শিক্ষা বোর্ডে ১৩টি পত্রের মধ্যে মাত্র তিনটি পত্রের পরীক্ষা নেওয়া গেছে। এই বোর্ডের অনেক শিক্ষার্থী ভালো প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত সব পরীক্ষা শেষ করতে পারেননি। 

বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ফল অন্য শাখার চেয়ে তুলনামূলক বেশি ভালো। পাসের হার সামান্য কমলেও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির ছড়াছড়ি এবার চোখে পড়ার মতো। 
সার্বিকভাবে এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. তপন কুমার সরকার সমকালকে বলেন, সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের কারণে এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে জিপিএ ৫-এর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু পাসের হার কমেছে। এর পরও একটা গ্রহণযোগ্য রেজাল্ট দিতে পেরেছি।
তিনি বলেন, বাতিল হওয়া বিষয়গুলোর পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল। অভিভাবক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে অনুরোধ রইল, ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। পরীক্ষাগুলো দেওয়া উচিত। পরীক্ষার মাধ্যমেই ফলাফল আসে। আমরা কতটুকু শিখলাম, তার যাচাই পরীক্ষার মাধ্যমেই হয়। 

যেসব বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মধ্যে ছিল ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি)। এ দুটি বিষয়ে এ বছর সবচেয়ে বেশি ফল খারাপ হয়েছে। ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ফল সবচেয়ে খারাপ করেছে যশোর ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার বলেন, আমাদের ৩১ ভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ফেল করেছে। সার্বিক ফলাফলকে তা ধাক্কা দিয়েছে। এবারের এইচএসসি শিক্ষার্থীরা নবম-দশম শ্রেণিতে ২০২০-২০২১ সালে করোনার কারণে সরাসরি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পায়নি। তারা সংক্ষিপ্ত সিলেবাস, কম নম্বরে পড়েছে। তাদের মাধ্যমিকে শিখন ঘাটতি রয়ে গেছে, যা তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তা নিয়েই তারা এবারের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। 

ফলাফলের তলানিতে থাকা ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবু তাহের বলেন, ইংরেজি ও আইসিটির ফল খারাপ করায় ময়মনসিংহ বোর্ডের ফল এবার নিম্নমুখী। ইংরেজিতে ৭৭ ভাগ এবং আইসিটিতে ৭৩ ভাগ মাত্র পাস করেছে। বোর্ডের গড় পাসের হার ৬৩ দশমিক ২২ ভাগ। শেরপুর ও ময়মনসিংহের চরাঞ্চল, নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার কলেজগুলোতে আইসিটি শিক্ষক নেই। থাকলেও তাদের মান আশানুরূপ নয়। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নিজেদের ফল নিয়ে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক অরুণ চন্দ্র পাল বলেন, কঠিন পরিস্থিতিতে সিলেট শিক্ষা বোর্ড অনেক ভালো করেছে। দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। আগামীতে সিলেট শিক্ষা বোর্ড আরও ভালো করবে।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, চট্টগ্রামে পাসের হার কিংবা জিপিএ ৫ সব দিক থেকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো ফলাফল করেছে। 
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল করিম বলেন, এবার ফলাফলের অনেকগুলো প্রতিকূলতা পার করতে হয়েছে। বন্যা ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের পাশাপাশি এবার ছাত্র আন্দোলনের কারণে সম্পূর্ণ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল, যার কিছুটা প্রভাব পড়েছে পরীক্ষায়। 
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক স ম আব্দুস সামাদ আজাদ বলেন, সেসব প্রতিষ্ঠান খারাপ করেছে, সেগুলোকে শোকজ করা হবে। তবে এগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কম ও বেশির ভাগ এমপিওভুক্ত নয়, তাই প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়াও কঠিন। তার পরও আমরা জবাব চাইব। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৫ জনের কম হয়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের অনুমতি দেওয়া হবে না।
বিভাগভিত্তিক ফলাফলের তুলনা দিয়ে তিনি বলেন, এ বছর অন্য বিভাগের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এবার বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৯১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, মানবিকে পাসের হার ৫৭ দশমিক ১১ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পাসের হার ৭৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। জিপিএ ৫ও বেশি পেয়েছে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা।


 

আরও পড়ুন

×