আ’লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বিচারের মুখোমুখি
হাসিনার বিচারে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতের তাগিদ
বিচার ত্রুটিপূর্ণ হলে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়বে : আবুল কাসেম ফজলুল হক

হাসিনা
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৪৩
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিচারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, এই বিচারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে বিদ্যমান আইনে সংশোধন করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ বিচার ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়াবে।
বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানা এবং সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তাদের মন্ত্রীরা এই আইনের পক্ষে নানা বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং এই আদালতের বিচারকে আন্তর্জাতিক মানের বলে দাবি করে আসছিলেন।
গতকাল সন্ধ্যায় লন্ডন থেকে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, এই আইন নিয়ে শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল। এই আইনে অবশ্যই সংশোধন দরকার। তবে ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে এখনই কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
বাংলাদেশের সংবিধানে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে বিষয়টি সংযুক্ত হয় ১৯৭৩ সালে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এই ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অনেকের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আরও কয়েকজনের বিচার ট্রাইব্যুনালে চলছিল।
এদিকে, আইনে পরিবর্তন আনার কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে গণহত্যার অপরাধে সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনাসহ আট দফা পরিবর্তন করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান অবসরে যান। আর এক সদস্যকে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। অপর সদস্য অব্যাহতি নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউটররাও পদত্যাগ করেছেন। ১৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল। এর আগেই চিফ প্রসিকিউটর এবং তদন্ত সংস্থার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়।
তদন্ত সংস্থার কাছে এরই মধ্যে ৬০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। নিয়ম হলো, অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত সংস্থা তদন্ত করে অভিযোগের প্রমাণ পেলে প্রসিকিউশনের কাছে মামলার জন্য জমা দেবে। প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে মামলা করবে।
সমকালের সঙ্গে আলাপকালে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, শেখ হাসিনাসহ যাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে পরোয়ানা জারি হয়েছে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সত্য। তাই বিচার করতে কোনো সমস্যা নেই। তবে আশাকরি বর্তমান সরকার বিচার শুরুর আগে আইনটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হালনাগাদ করবে। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের অভিযোগ গণহত্যার আওতায় পড়বে না, তবে এটা সুস্পষ্টভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়বে। ইতোমধ্যে পরোয়ানা জারি করা হলেও বিচার শুরু হতে আরও সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে অবশ্যই সরকার আইনটি সংশোধনে পদক্ষেপে নেবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। তাদের মধ্যে শেখ হাসিনার জন্য ট্রাভেল পাস ইস্যু করেছে ভারত। তবে আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা কীভাবে ভারতে রয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এরই মধ্যে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সবই করবে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি বলেন, আদালত এক মাস সময় দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে তাঁকে (শেখ হাসিনা) ফেরত আনার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা অবশ্যই করবেন তারা।
তবে সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, তরুণদের গড়া বাংলাদেশকে ভারতের নতুন লেন্সে দেখতে হবে। শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানো ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এর তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সমন জারি করেছেন, এটা তামিল করার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের কাছে অনুরোধ করতে পারে এবং ভারত তাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এমন তো হতে পারে, শেখ হাসিনা নিজেই এই সমন জারির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় এসে আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে পারেন। এটা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তৃতীয়ত, শেখ হাসিনা যদি না আসতে চান, ভারত যদি মনে করে তাদের বন্ধু, যেটা তারা বৃহস্পতিবারও উল্লেখ করেছে, নিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনা দিল্লিতে আছেন, তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি যদি ভারতকে বলেন, না আমি যাব না। তখন একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় আসবে। একটা আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, তারা সেটাকে সম্মান দেখাতে পারে অথবা সম্মান না দেখিয়ে বলতে পারে, আমরা তাঁকে পাঠাব না।
ট্রাইব্যুনালের এই সমনের তালিকায় আওয়ামী লীগের বর্তমান শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও একমাত্র পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামও রয়েছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে আসার মতো যে কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রেহানা ও জয় অন্যতম। তবে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, সমন জারি হলেও এই বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য এখনও দলীয়ভাবে কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটিও এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় বিচারকাজ মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে দলে এখনও আলাপ-আলোচনা শুরু হয়নি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দিতে হয়তো আরও সময় লাগবে। এর মধ্যে হয়তো এসব বিষয়ে দলীয় কৌশল নির্ধারণ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিচার প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হলে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়বে। বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারও বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা দিয়েছিল। তবে তাদের হয়রানি করে ক্ষমতায় থাকার সময় বাড়াতে পারলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়নি। শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার কোনো পরিচয় ফুটে ওঠেনি।
তিনি বলেন, অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ব্যর্থ হয়, তখনই দেশে সামরিক শাসন আসার পথ সুগম হয়। কিন্তু এখন বিশ্ব রাজনীতিতে নানা মেরূকরণ ঘটছে। এখন ক্ষমতাধর প্রভাবশালী দেশগুলো নানাভাবে ছোট দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও দল হিসেবে নিঃশেষ হয়ে যাবে না। তবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিদেশি প্রভাব বাড়তেই থাকবে।
- বিষয় :
- হাসিনার পতন