ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সৌর সেচের আয়োজনে অব্যবস্থাপনার ধাক্কা

সৌর সেচের আয়োজনে অব্যবস্থাপনার ধাক্কা

.

 জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২৯ | আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৩

দেশের বেশির ভাগ কৃষক তাঁদের কৃষিজমিতে সেচ দিতে ডিজেলচালিত ইঞ্জিন ও বিদ্যুৎ–চালিত মোটরের সাহায্য নিচ্ছেন। এতে ফসল উৎপাদন খরচ যেমন বেড়ে যায়, তেমনি কৃষকদের সেচ নিয়ে পোহাতে হয় ভোগান্তি। গত সরকার কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিশক্তির ব্যবহার বাড়াতে সৌর সেচ প্রকল্পের ওপর জোর দেয়। কম দামে সেচ দেওয়া, বছরে অন্তত তিনটি ফসল উৎপাদন, নবায়নযোগ্য ও কার্বন নিঃসরণহীন শক্তি উৎপাদন করে জলবায়ুর পরিবর্তন রুখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি নানা সংস্থাও সৌর সেচ প্রকল্পের দিকে ঝুঁকতে থাকে। এতে কৃষকেরও আগ্রহ বাড়ে। সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে জমি ভেজাতে থাকেন কৃষক। কিন্তু কিছু এলাকায় সুফল মিললেও অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক কৃষক পাচ্ছেন না সৌর সেচ প্রকল্পের সুবিধা। লক্ষ্য পূরণে কাজ করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিইএ) দুটি প্রকল্প অব্যবস্থাপনায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। আবার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির (ইডকল) একটি প্রকল্পে ৯ বছরে ১০ হাজার সৌর সেচ পাম্প বসানোর কথা থাকলেও ৫ বছরে দেড় হাজারের মতো বসানো হয়েছে। 

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) গবেষণামতে, বাংলাদেশে ১৩ লাখ ডিজেলচালিত সেচ পাম্প রয়েছে, এগুলো সোলার পাম্পে রূপান্তর করা হলে বছরে ডিজেল সাশ্রয় হবে ৪ লাখ টন, যার মূল্য প্রায় ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেলচালিত পাম্পের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে– এগুলোকে সৌর সেচে রুপান্তরে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য সরকারকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দিতে হবে ভর্তুকি। পাশাপাশি প্রান্তিক কৃষকদের সৌর সেচ ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে উদ্ভাবনী এবং ভর্তুকিযুক্ত জলবায়ু তহবিলের অর্থায়ন সংগ্রহ করা উচিত।

বাস্তবে অচল কাগজে কলমে সচল
বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় তথ্য বলছে, কৃষির ৪৩ ভাগই খরচ হয় সেচ কাজে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ (বিএডিসি) সরকারের কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে এটি বাস্তবায়ন সহযোগিতা করছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ইডকল)। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, দেশে মোট তিন হাজার সেচ পাম্পের মধ্যে ৮০.৯ ভাগই ইডকলের। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৮.৪ শতাংশ, বিএডিসির ৫.৮ শতাংশ, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ৪.১ শতাংশ এবং অন্যান্য ০.৮ শতাংশ। কিন্তু সৌর চালিত সেচপাম্প জনপ্রিয় করার চেষ্টা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ইডকল ঘোষণা দেয়, ২০১৬ সালের মধ্যে সারাদেশে তারা ১৮ হাজার ৭৫০টি সৌর সেচ পাম্প স্থাপন করবে। ২০১৮ সালে ইডকল ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ হাজার সৌর সেচ পাম্প স্থাপন করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে। পরে টার্গেট পূরণ হওয়া সম্ভব না দেখে লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার পাম্প স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। প্রতিষ্ঠানটি যখন দেখল ২০২৭ সালেও এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব না, তখন আবারও পিছিয়ে তা ২০৩০ সাল নাগাদ মাত্র ১০ হাজার ডিজেল পাম্প সৌর সেচ পাম্পে রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা নেয়। তারপরও গেল ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটি সৌর সেচ পাম্প স্থাপন করতে পেরেছে মাত্র ১৫২৩টি। ৪০০-৫০০ ওয়াট সক্ষমতার সোলার পাম্পের দাম প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। এই খরচের ৩৫ শতাংশ দেয় ইডকল, বাকিটা ব্যাংক গ্যারান্টি এবং কৃষকদের নিজেদের বহন করতে হয়।  বার বার উদ্যোগে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে ইডকল দায়ী করেছে, যথাযথ  ব্যাংক গ্যারান্টি ও আর্থিক সম্পদের অভাবকে। 

চাষাবাদে সাশ্রয়ী হওয়ার পরও কেন এই দুর্বাবস্থা- সেটি মাঠ পর্যায়ে খোঁজার চেষ্টা করেছে সমকাল। ইডকলের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগের প্রধান এনামুল করিম পাভেল বলেন, সচেতনতার একটা চ্যালেঞ্জ শুরু থেকেই ছিল। অনেক সময় দেখা যায় বৈদ্যুতিক পাম্প আমাদের চেয়ে কম দামে দিচ্ছে। সংখ্যায় বিবেচনা না করলে আমরা অনেক বেশি অর্জন করেছি। প্রশ্ন ছিল বসানো পাম্পগুলো সচল আছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,  কোনো পাম্প নষ্ট হলে মাঠে ঠিক করা যায় না, সার্ভিস সেন্টারে পাঠাতে হয়। এতে দুই তিন সপ্তাহ কিংবা এক মাস সময় লাগে।

মাঠ পর্যায়ের অবস্থা কি তা জানতে সরেজমিন গাইবান্ধায় গেল দেখা যায় বিপরীত চিত্র। এ জেলায় ৬৫টি সৌর সেচ পাম্পের মধ্যে ইডকলের আছে ৪৮টি। গাইবান্ধার সাঘাটা ইউনিয়ন কচুয়া হিন্দুপাড়া কারখানা মাঠে ইডকলের অর্থায়নে গ্রীণ হাউজ এন্ড এনার্জি লিমিডেটের নামে ২০১৫ সালে স্থাপন করা একটি সৌর সেচ পাম্প চলার কথা। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা)ওয়েব সাইটেও এই পাম্পটি সচল বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়েই চোখে পড়লো কয়েকটি সৌর প্যানেল উধাও। 

পাম্পটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা মো. সুজন জানালেন, 'অনন্ত ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১০ কিলোওয়াটের এই পাম্প অচল পড়ে আছে পাঁচ বছর। এক বছর তিন মাস আগে চোর এসে তিনটি সোলার খুলে নিয়ে গেছে। আর চারটি সৌর প্যানেল খুলে রাখলেও নিয়ে যেতে পারেনি। বিদ্যুত যে পরিমান এসে সঞ্চয় হয়, সে পরিমান সরবরাহ করতে পারে না। দায়িত্বশীল লোকজন এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন  ইনভার্টারের সমস্যা। দুই বছর নষ্ট থাকার পর খুলে নিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু খুলে নেওয়ার তিন বছরেও আর সেই যন্ত্র আসেনি। এখন পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর ধরে অচল অবস্থায় আছে এই পাম্প। বার বার বলার পরও কেউ আসে না।' 

কচুয়া হিন্দুপাড়া কারখানা মাঠ এলাকায় একই ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি সৌর সেচ পাম্প রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন সুমন মিয়া। দুই বছর আগে নষ্ট হওয়া পাম্প মেরামতের কথা বলে কর্তৃপক্ষ নিয়ে গেলেও এখনও তার হদিস নেই। তিনি বলেন, 'দুই বছর নষ্ট হয়ে পড়েছিল। পরে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের কাছে চাওয়া হলে তারা যন্ত্র লাগিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু লাগানো হয়নি। এক পর্যায়ে আমাদের জানানো হয় কর্তৃপক্ষ খরচ দিতে পারবে না। তারপর ঋণ নিয়ে  ইনভার্টার কিনে চালানো হয়েছে। এখনও সেই কিস্তি শোধ করছি।'

গাইবান্ধা নাকাইহাট এলাকায় ৫০০ মিটারের মধ্যে সৌর সেচ পাম্প বসানো হয়েছে ছয়টি। সবগুলো সচল থাকলেও কৃষক আয়ুব আলী যেটি দেখাশুনা করেন তা অচল। এক দফা নষ্টের পর তিন মাস ধরে এটি আবারও অচল হয়ে যায়। আয়ুব আলী বলেন, ৬-৭ বছর আগে সৌর প্যানেল নেওয়া হয়েছে। দুই বছর ধরে প্যানেলটি নষ্ট হয়ে আছে। 

এ বিষয়ে গ্রীণ হাউজ এন্ড এনার্জি লিমিটেডের টেকনিক্যাল ম্যানেজার মৃত্যুঞ্জয় বলেন, ১২টির মতো সৌর সেচ পাম্প এখন অচল আছে। আমরা যে নতুন করে টাকা বিনিয়োগ করবো, সেই টাকাটা তো আমাদের থাকতে হবে। কিভাবে এখান থেকে বের হওয়া যায় তা ইডকল মাস্টারপ্ল্যানে রেখেছে। আমরা বিষয়টি ইডকলকে জানিয়েছি, তারা বহুবার পরিদর্শনও করেছে। 

ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা দিপাল বড়ুয়া বলেন, ইডকল থেকে একটি পাম্প নিতে কমপক্ষে ৩০টি কঠিন শর্ত পূরণ করতে হয়, সবচয়ে কঠিন শর্ত হলো ১০০ শতাংশ ব্যাংক গ্যারান্টি। তারপর এই প্রযুক্তি গ্রহণ করার পর কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তির দিক দিয়ে কোন সহায়তা করে না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যই সোলার সেচ ব্যবস্থায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়। এতে ভারতে তৃণমূল পর্যায়ে একটা বিশাল বিপ্লব তৈরি হয়েছে। ভারতে কৃষকরা গত এক দশকে ৩ লাখের বেশি সোলার পাম্প স্থাপন করতে পেরেছেন। আর এই পাম্পগুলোর বেশিরভাগই গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত, যার ফলে অনেক গিগাওয়াট (গিডব্লিউ) বিদ্যুৎ কেবল সোলার সেচ থেকেই পাওয়া যায়। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের দুই প্রকল্পের সম্ভাবনা হারিয়ে গেল অব্যবস্থাপনায়
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘সৌরশক্তি ও পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি (পাইলট)’ প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে। গত বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। প্রকল্পের আওতায় ৬৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০০ উপজেলায় ১০৫টি সোলার সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়। ৮২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বিএডিসির ‘সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন’ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের অক্টোবরে শুরু হয়ে গত বছরের জুনে শেষ হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয় ৩৪ জেলার ১৪১ উপজেলায়। 

প্রতিটি সেচ পাম্প চালানোর জন্য স্থানীয়দের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কমিটি। প্রতি শতাংশ জমির জন্য ৫০ টাকা করে সেচ খরচ নেয় ওই কমিটি। এ কমিটি প্রতিবছর সরকারকে ১৫ হাজার টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করে। মাঠ পর্যায়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সরকারের এ সেবা সম্পর্কে অনেকেই জানেই না। এমন অভিযোগও রয়েছে, এ সেবা নিতে কৃষককে গুনতে হয় বাড়তি টাকা। কিছু এলাকায় সৌর সেচ পাম্প উদ্বোধনের পর বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে আবার অনেক স্থানে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। ফলে সরকারের প্রায় দেড়শ কোটি টাকার দুই প্রকল্প মাঠে মারা গেল।

মানিকগঞ্জের ঘিওরের সদর ইউনিয়নের পুরোনো ধলেশ্বরী নদীর উত্তরপাড়ে চর ঘিওর এলাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৭ টাকা খরচ করে একটি সৌরচালিত সেচ পাম্প বসায় বিএডিসি। এখনও পাম্পটি অচল পড়ে আছে। ফলে সদর ইউনিয়নের চর ঘিওর এলাকার শতাধিক চাষি সেচ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কৃষক জহির মিয়া ও  দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রতি বিঘায় ১ হাজার টাকা হারে সেচ খরচ নেওয়ার কথা ছিল। তবে সৌরচালিত পাম্পটি চালু না হওয়ায় এখন বিদ্যুৎচালিত পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিতে গিয়ে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।

পাম্প পরিচালনার দায়িত্বে থাকা স্কিম ম্যানেজার ও সমিতির কোষাধ্যক্ষ রুহুল খান বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তিন দফা চেষ্টার পরও পাম্পটি চালু করা যায়নি।

গাজীপুরের শ্রীপুরে নান্দিয়া সাংগুন গ্রামে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিএডিসির সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ প্রকল্প। শীতলক্ষ্যা নদীতীরে বসানো সেচ পাম্পটির আওতায় জমি রয়েছে প্রায় ৫০ বিঘা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পাম্পটি নদীর কম গভীরে স্থাপন করা হয়েছে। নদীর পানি একটু নিচে নামলে আর পানি ওঠে না।

বিএডিসি (ক্ষুদ্র সেচ) গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী ফারুক হোসেন জানান, সূর্যের আলো কম ও নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এ পাম্প দিয়ে ধানক্ষেতে সেচ দেওয়া যায় না। তবে সবজি ক্ষেতের জন্য এটি যথেষ্ট। এ সৌর পাম্প নদীনির্ভর। এ পাম্প দিয়ে ভূগর্ভস্থ থেকে পানি তোলার নিয়ম নেই।

ভোলার চরফ্যাসনের বিএডিসির প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে উপজেলার চারটি ইউনিয়ন। এর মধ্যে হাজারীগঞ্জ ও আবুবকরপুর ইউনিয়নে একটি করে ও আব্দুল্লাহপুরে দুটি পাম্প আছে। তবে এখানে সেচ সুবিধা পেতে কৃষককে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। উপকারভোগী কৃষক লোকমান হোসেন ও কামাল হোসেন জানান, প্রতি শতাংশ জমিতে সরকার ৫০ টাকা নির্ধারণ করলেও সেচ কমিটিকে দিতে হচ্ছে ৭০ টাকা।

চরফ্যাসনের হাজারীগঞ্জ ২ নম্বর ওয়ার্ডের সেচ কমিটির সভাপতি কৃষক আয়ুব আলী বলেন, শুরুতে এককালীন সরকারি কোষাগারে ৩০ হাজার টাকা জমা দিয়েছি এবং বছর বছর ৭ হাজার টাকা জমা দেওয়া লাগে। তাই বাড়তি টাকা না নিলে আমার লোকসান হবে।
বাড়তি টাকা নেওয়া হলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান বিএডিসির চরফ্যাসন উপজেলার সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন।

বরগুনার পাথরঘাটার মানিকখালী গ্রামে স্থাপনের দুই বছরেও চালু হয়নি বিএডিসি নির্মিত সোলার সেচ পাম্প। এমনকি পরিশোধ করা হচ্ছে না বার্ষিক ভাড়া ১৫ হাজার করে টাকাও। স্থানীয় কৃষকদের সমন্বয়ে সমিতির মাধ্যমে পাম্প পরিচালনার জন্য (স্কিম ম্যানেজার) সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্য হেমায়েত উদ্দীন অপুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।  তিনি বলেন, পাম্প-সংলগ্ন খাল থেকে পানি না পাওয়া, লবণ-পানি ওঠানামা বন্ধ করতে খালে স্লুইচগেট নির্মাণ না করায় পাম্পটি চালু করা যাচ্ছে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হয়েছে বরিশালের গৌরনদীতে। সেখানকার কয়েকজন কৃষক বলেন, দিনে সূর্যের তাপে সৌর প্যানেলগুলো সচল থাকায় সেচকাজ পরিচালনা করা যায়। তবে রাতে বন্ধ থাকে। সৌর প্যানেলের সঙ্গে ব্যাটারি সংযোজন করা হলে রাতেও সেচকাজ করা যেত।

২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের ৯ নম্বর দক্ষিণ চর আবাবিল এলাকার বালুধুম গ্রামে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সৌর সেচ প্রকল্প শুরু করে। কৃষকের অভিযোগ, সোলারের বিদ্যুৎ দিয়ে যে পানি পাওয়া যায়, তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে তাদের বাড়তি টাকা খরচ করে ডিজেলচালিত পাম্পের মাধ্যমে জমিতে সেচ দিতে হয়। স্থানীয় কৃষক আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে বালুধুম কৃষক সমিতি নামে একটি দল গঠন করা হয়। কাগজপত্রে উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা ২০ জন দেখানো হলেও বাস্তবে মাত্র তিনজন। তাদের মোট জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৮০ একর।

কৃষকদের অভিযোগ, গাছের ছায়ায় প্যানেলগুলো ঢাকা থাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় সেচ পাম্পটি চলছে না। প্রকল্প এলাকায় সুবিধাভোগী কৃষক বিউটি আক্তার, নুর মোহাম্মদ ও আবদুল ছামিদ বলেন, সোলারের সঙ্গে ব্যাটারি যুক্ত থাকলে সবসময় পাম্প চালানো সম্ভব হতো।

স্থানীয় কৃষক আব্দুল মান্নানের নামে প্রকল্প হস্তান্তর করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তিনি জানান, গত বছর তাঁকে প্রকল্পের আওতায় একটি সেচ পাম্প, সোলার প্যানেল ও পাম্প স্থাপনের জন্য ঘর করে দেওয়া হয়। তবে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় এক চাষির অভিযোগ, কৃষকের মতো না নিয়েই লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেখানে পাম্প স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে খালে পানি থাকে না। তা ছাড়া গাছের নিচে সৌর প্যানেল বসানোর কারণে সূর্যের আলো মিলছে না। এ ব্যাপারে রায়পুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন বলেন, শুরুতে দ্রুত প্রকল্পের কাজ চালু করার তাগাদা ছিল। ফলে ভালোভাবে পরিকল্পনা করা যায়নি। এখন সেচ পাম্পটি স্থানান্তর করে উপযুক্ত স্থানে নিতে হলে বরাদ্দ লাগবে। সব সমস্যার কথা আমরা অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। আগামীতে এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য ব্যাটারি দেওয়ার কথা আমরা জানিয়েছি। কাগজপত্রে প্রকল্পের উপকারভোগী ২০ জন থাকলেও বাস্তবে তিনজন থাকার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, শুরু থেকে ২০ জনই সুবিধা পেয়েছেন। এখন হয়তো পানি কম উঠার কারণে অনেকে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

এ দিকে নাটোরের লালপুরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সমন্বিত সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত ২৫টি গভীর সেচ পাম্প প্রায় ১৩ থেকে ৫৪ বছর ধরে অকেজো পড়ে আছে। এতে কৃষকের সেচ ভোগান্তি ও খরচ বেড়েছে। অগভীর নলকূপ স্থাপন করে শুষ্ক মৌসুমে ঠিকমতো পানি পাচ্ছেন না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্পটির সাবেক উপপ্রকল্প পরিচালক অশোক কুমার বিশ্বাস বলেন, পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি চালানো হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। 

বিএডিসির প্রকল্পের পরিচালক মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, সেচ পাম্প মূলত কৃষকদের মাধ্যমে গঠিত সমিতি পরিচালনা করে। আমরা শুধু তদারক করি। তিনি বলেন, সৌর প্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। এসব কাজ স্থানীয়দের নিয়ে গঠিত কমিটির করার কথা।

বিশেষজ্ঞ মত
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার মন্ডল বলেন, সোলার পাম্প স্থাপনের জন্য কৃষকরা সঠিক স্থান পান না। ফলে বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎ পাম্প ব্যবহার করে থাকেন। সোলার পাম্পের খরচও বেশি। সরকার খুব কম খরচে সোলার পাম্প সরবরাহ করলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে। সোলার সেচ পাম্পের প্রসার বাড়াতে হলে লাভজনক বিজনেস মডেল দাঁড় করাতে হবে। সোলার পাম্পগুলো রক্ষণাবেক্ষণ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সৌরচালিত সেচ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য কাঠামোগত সক্ষমতা লাগবে। সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাহলে কৃষকরাও এটি গ্রহণ করতে আরো বেশি আগ্রহী হবে।

অ্যাকশন এইডের জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশনের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, সৌরবিদ্যুৎ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে  সৌরসেচ প্রকল্প বাংলাদেশের একটি বিরাট সম্ভাবনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা যেমন রয়েছে তেমনি মুলে রয়েছে নীতি ও পরিকল্পনাগত ত্রুটি।  সমস্যা হল, নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় বাস্তবতা ঠিকঠাকমত বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হই। কারণ নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণে স্থানীয়দের প্রায়শই অবজ্ঞা করা হয়। সৌরসেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে সোলার ইরিগেশন পাম্পের গ্রিড ইন্টিগ্রেশনের জন্য স্রেডা যে নির্দেশিকটি তৈরি করে তার মধ্যেই সমস্যা রয়েছে।

প্রথমত: এর ট্যারিফ কাঠামোটি গ্রাহকের অনুকুলে নয়। এ ধরণের নতুন প্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গ্রাহক বান্ধব ট্রারিফ কাঠামো প্রণয়ন করা উচিত ছিল। যাতে গ্রাহক এরকম একটি প্রযুক্তি গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠে। কিন্তু তার চেয়ে বড় সমস্যা হল, এর মিটারিং কার্যক্রম ব্যবস্থা। প্রথমত ইরিগেশান পাম্প সারাবছর ব্যবহার হয় না। সিজনে প্রচুর চাপ থাকে তখন অতিরিক্ত বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। আবার অফসিজনের চাপ কমে যায়। ফলে সিজনে স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বা গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার প্রয়োজন হয়।

অন্যদিকে অফসিজনে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিডে দিয়ে গ্রাহক আয় করতে পারেন। প্রথমত: বেশিরভাগ গ্রাহক গ্রিডে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারেন না। কারণ গ্রিডের সেই সামর্থ্য নেই। অন্যদিকে প্রয়োজনের সময় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার প্রক্রিয়াটি করা হয়েছে জটিল ও ব্যয়বহুল। গ্রিড লাইনের সক্ষমতা না বাড়িয়ে এ ধরণের মডেল কৃষককে দেয়াটা ঠিক হয়নি। এর ফলে সৌরসেচ প্রকল্প সম্পর্কে কৃষক ও গ্রাহক পর্যায়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরী হচ্ছে। অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠের উপর থেকে পানি তোলার জন্য যে সকল সৌরসেচ প্রকল্প দেয়া হয়েছে, সেই মডেলটিও বাস্তবতা বিবর্জিত। 

আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রয়োজন ছিল পোর্টেবল মিনি সৌরসেচ মডেল দেয়া, যেটা কমখরচে ও সহজে ব্যবহার করা যায়। যেখানে পানির সহজলভ্যতা আছে, সেখান থেকে সহজেই পানি তুলতে পারে। ফলে সৌরসেচ প্রকল্প বাস্তবায়নে ট্যারিফ কমানোর পাশাপাশি গ্রিডের সক্ষমতা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে পুরো মডেলটি পূণর্মূল্যায়ন করতে হবে। যাতে গ্রাহক সহজে সংযোগ নিতে পারেন। গ্রাহককে ভর্তুকী দিতে হবে। এবং সৌরসেচ প্রকল্প গ্রহণে ভূপৃষ্ঠের উপরের পানি উত্তোলনের উপর জোর দিতে হবে। যাতে কৃষক পানির উৎস সংরক্ষণে সচেতন হয়। যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে মিনি পোর্টেবল সৌরপাম্প দিতে হবে যাতে কৃষক কম খরচে নিতে পারে ও সহজে পানি উত্তোলনের সুবিধা নিতে পারে।

আরও পড়ুন

×