তাজরীন ট্র্যাজেডির মামলায় কচ্ছপগতি

ফাইল ছবি
আবু সালেহ রনি
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১৪ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ২০:১৬
সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে খুবই ধীরগতিতে। এক যুগ আগে এ ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে অধিকাংশ সাক্ষীর ঠিকানায় তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে দফায় দফায় সমন জারি করলেও তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসছে না। এতে সুযোগ নিচ্ছে আসামিরা। তারা সবাই জামিনে মুক্ত।
এদিকে বিচারের ধীরগতিতে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা। পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি আসামিদের দ্রুত বিচারও দাবি করেন তারা। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে অন্তত ১১২ জন নিহত এবং দুই শতাধিক শ্রমিক আহত ও দগ্ধ হন। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় মামলা করে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় পরের বছরের ২২ ডিসেম্বর তাজরীনের চেয়ারম্যান মাহমুদা, দেলোয়ারসহ ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।
এতে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী আসামিদের বিরুদ্ধে ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আগুন লাগার পর শ্রমিকদের বের হতে না দিয়ে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কারখানাটিতে ১ হাজার ১৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন। দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন সেখানে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রায় তিন বছর পর ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন।
মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, অভিযোগপত্রভুক্ত ১৩ আসামির মধ্যে তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেনসহ ৮ জন উচ্চ ও অধস্তন আদালত থেকে জামিনে মুক্ত রয়েছেন। পলাতক অপর ৫ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না।
অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন– দেলোয়ার হোসেন, তাঁর স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল-আমিন, ইনচার্জ আনিসুর রহমান, স্টোর ইনচার্জ আল-আমিন, কারখানার ম্যানেজার আবদুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জু, কোয়ালিটি ম্যানেজার শহিদুজ্জামান দুলাল, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনারুল ও লোডার শামীম মিয়া।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ঢাকার আদালতে গত মাসে রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা নতুন করে নিয়োগ করা হয়। দীর্ঘদিন পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর এক সাক্ষীর আংশিক সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ২৭ নভেম্বর ফের সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী সমকালকে বলেন, সম্প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। পুরোনো মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে মামলাটিও দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
আসামি দেলোয়ার হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মাহমুদা আক্তারের আইনজীবী হেলেনা পারভীন সমকালকে বলেন, সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সাক্ষীদের অধিকাংশই শ্রমিক। তাদের হাজিরের জন্য বারবার সমন দেওয়া হলেও তারা আসছে না। অনেকের ঠিকানাও পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য মামলার বিচারে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে সুইং অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন নাছিমা আক্তার। দুর্ঘটনায় তাঁর মেরুদণ্ড ও ঘাড়ের হাড় ফেটে গেছে। দুই হাত ভেঙে যায়। মাথায় আঘাতের কারণে তিন বছর নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এখনও চিকিৎসা চলছে। প্রতি মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। ত্রিশোর্ধ্ব নাছিমা সমকালকে বলেন, ‘কোনো কর্ম করতে পারি না। স্বামী রিকশা চালায়। তিন ছেলে ও মেয়ে নিয়ে কষ্টে আছি।’ তিনি জানান, দুর্ঘটনার পর ২০১৬ সালে আইএলও থেকে আড়াই লাখ টাকা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কারিতাস ১৪ মাস চিকিৎসা বাবদ ৪ হাজার টাকা করে দিয়েছিল। দুর্ঘটনায় আহত সবিতা রানী ক্ষতিপূরণসহ চিকিৎসা খরচের পাশাপাশি অবিলম্বে তাজরীন হত্যাকাণ্ডে দোষীদের বিচার দাবি করেন।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার সমকালকে বলেন, আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় বিচারে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আমরা মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে আশাবাদী। তবে রাষ্ট্রপক্ষের তৎপরতা এখনও তেমন দেখা যাচ্ছে না। শিগগিরই শ্রমিকদের প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে সাক্ষী হাজিরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাগিদ দেবে। তিনি অভিযোগ করেন, বিগত সরকারের আমলে রাষ্ট্রপক্ষের মাধ্যমে আসামিরা বিচার বিলম্বিত করতে সাক্ষীদের নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
- বিষয় :
- তাজরীন ট্র্যাজেডি