বৈষম্যবিরোধী চেতনায় এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না

ছবি: সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:২৩ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:০০
বৈষম্যবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগের সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে। কিন্তু চেতনার মূল মর্মবস্তুকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আন্দোলনের মূল শক্তিগুলোর কেউ না কেউ বৈষম্য টিকিয়ে রাখার পক্ষেই যুক্তি দিচ্ছে। অথচ বৈষম্যবিরোধী কথা বলেই তারা এ পরিবর্তনের অংশ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের সোচ্চার ও জাগ্রত থাকার কোনো বিকল্প নেই।
গতকাল সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ আয়োজিত ‘সুশাসনের জন্য জনকেন্দ্রিক সংস্কার: সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক নাগরিক সম্মেলন ২০২৪-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের পরিচালনায় এবং সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ইউএনডিপির ডেপুটি রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ সোনালী দয়ারত্নে প্রমুখ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনের (এসডিসি) সহযোগিতায় দু’দিনের এ সম্মেলন শুরু হয়েছিল রোববার।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, অতীতে অনেক কমিশন করা হয়েছিল, যা এখন ঠিকমতো কাজ করছে না। আরও যে নতুন কমিশন হবে, সেগুলো কীভাবে কার্যকর করা যায়, তা ভাবতে হবে। আমলাতন্ত্রকে অনেকে দোষারোপ করলেও এটি ছাড়া চলবে না; একইভাবে রাজনীতিবিদ ছাড়াও চলবে না। ব্যবসায়ীরাও থাকবেন। তাই আমরা চাই, এসব ভালোভাবে চালানোর বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। তারা যেন কাজ করেন, তার জন্য তাদের সার্বক্ষণিক দায়বদ্ধতা ও নজরদারির ওপর রাখতে হবে। এই দায়িত্বটা নাগরিকদেরই। তিনি বলেন, আগেও যে দুর্নীতি ছিল না, তা নয়। তখন দুর্নীতিবাজের তালিকায় নাম আসায় একজন আমলার আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছিল। অর্থাৎ সমাজে দুর্নীতি গ্রহণযোগ্য ছিল না। এখন বড় বড় দুর্নীতির কথা আমরা শুনি। এটি করেও যে কেউ আত্মহত্যা করবেন, তা আমার মনে হয় না। তাই আমাদের এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে; লেগে থাকতে হবে।
অনুষ্ঠানে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমলারা এখন নানা পরিচয়ে মানুষের সামনে হাজির হন, যা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে যে আমলা, কাল সে রাজনীতিবিদ, পরের দিন সে ব্যবসায়ী। এটিই তো সমস্যা হয়ে গেছে। উনারা বহুরূপে এখন আমাদের সামনে আসেন।’
অনুষ্ঠান সঞ্চালনার এক পর্যায়ে ড. দেবপ্রিয় অংশগ্রহণকারীদের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, কে বেশি ক্ষমতাধর– আমলা, রাজনীতিবিদ নাকি ব্যবসায়ী? এমন প্রশ্নের জবাবে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে জবাব আসে– আমলারা। এর পর তিনি বলেন, সারাদেশ ঘুরে আলোচনায় আমলাদের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো অন্য জায়গায়। অনেক ক্ষেত্রে এই তিন পরিচয় একই ব্যক্তির হয়ে গেছে।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কমিশন হলে সাধারণ অজুহাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের সংস্কৃতি রোধ করা যায় এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া যায়। স্থানীয় সরকারে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহারের বিধান প্রত্যাহারের সুপারিশও করেন তিনি। সংসদে নারীর সংরক্ষিত আসন রাখার প্রস্তাব করে তিনি বলেন, নির্বাচনী এলাকাগুলোতে নারীর সংখ্যানুপাতও নিশ্চিত করতে হবে। সংরক্ষিত আসনে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ মানুষ দুটি ভোট দেবেন; একটি সাধারণ আসনে, অন্যটি সংরক্ষিত আসনে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যে বৈষম্যবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগের সরকারকে ফেলে দিলাম, সেই চেতনার মূল মর্মবস্তুকে ধারণ করতে হবে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী চেতনার মূল শক্তিগুলোর ভেতর কেউ না কেউ বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে যুক্তিতর্ক দিচ্ছে। অথচ বৈষম্যবিরোধী কথা বলেই তারা আজকের এই পরিবর্তনের অংশ হয়েছে। তিনি বলেন, এই আন্দোলনের মাধ্যমে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে সবাইকে অংশ নিতে হবে। এই চাহিদা যদি অব্যাহত না থাকে, আর মনমতো সব পরিবর্তন হবে– এই কথা ভাবলে বোকার স্বর্গের বাস করা হবে। সক্রিয় থাকতে হবে; একতাবদ্ধ থাকতে হবে। বৈষম্যবিরোধী চেতনার মূল বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠ থাকতে হবে। এর জন্য আগামীতে একত্রিতভাবে আওয়াজ তুলতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কল্যাণমুখী সরকার গঠিত হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচিত সরকার পরবর্তী পাঁচ বছর মানবাধিকারের সুরক্ষা দিল কিনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চর্চা করল কিনা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করল কিনা– এর ওপর সুশাসন নির্ভর করে।
তিনি জানান, সংস্কার কমিশনে এখন সবার পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে সুপারিশ নেওয়া হবে, বিকল্পও থাকবে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো দেওয়ার পর এগুলো নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। এর মাধ্যমে একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর পর বহু কথিত রোডম্যাপ তৈরি হবে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হবে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মনোনয়ন বাণিজ্য। দৃশ্যমান নির্বাচনী ব্যয় হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। কিন্তু অদৃশ্যভাবে যে শতকোটি টাকা লেনদেন হয়, এটি কীভাবে দূর করা যাবে? এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে রাজনীতিবিদদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। সবাই যদি সোচ্চার হয়ে জোরালোভাবে মতামত ব্যক্ত করা যায়, তাহলে কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ বেশি থাকবে। তা না হলে হবে না। এই দায়িত্বটা সবার।
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রতিষ্ঠান ও মানুষ– দুটিরই সংস্কার প্রয়োজন। পৃথিবীতে সব দেশে দুর্নীতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিকে দুর্নীতি প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যাতে অন্যরা দুর্নীতি করতে নিরুৎসাহিত হন। সেই জায়গায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে যেসব প্রতিষ্ঠানের কাজ করার কথা, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর নয়। উল্টো প্রতিষ্ঠানগুলো দখল হতে দেখা গেছে। ফলে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের জন্য অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে কাজও হচ্ছে। কিন্তু দুদক একা দুর্নীতি দমন করতে পারবে না। সবাইকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আইন ও কমিশন করে দুর্নীতি দমন করা যাবে না।
তিনি বলেন, আগে ধারণা ছিল, মানুষ দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করে। এখন দুর্নীতিবাজকে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নিয়োগের সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে। এই যে দুর্নীতিকে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি, তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। ৫ আগস্টের পর তরুণদের চাওয়া যে নতুন বাংলাদেশ, রাষ্ট্র সংস্কার, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত– এসব জায়গায় পৌঁছাতে যে পরিক্রমা প্রয়োজন, সেখানে পুরো সমাজকে ভূমিকা রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপের সমালোচনা করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোতে বৈচিত্র্যের প্রতিফলন ঘটেনি। এর জন্য আমরা বিব্রত ও উদ্বিগ্ন। এমনটি হওয়া উচিত ছিল না। কর্তৃত্ববাদের বর্জনের কথা বললেও কর্তৃত্ববাদের চর্চাটা বর্জন করা হচ্ছে না। এই সরকারের আমলে ‘মাইনোরিটি অ্যান্ড ডাইভারসিটি কমিশন’ দরকার; মন্ত্রণালয় দরকার। এর দায়িত্ব থাকবে আদিবাসী এবং বৈচিত্র্যের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। এটি করতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষা কমিশন হয়নি। আন্দোলনের মূল ক্ষেত্র ছিল শিক্ষা। শিক্ষা খাতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। এখানে সরকার হাত দেয়নি। কেন হাত দেয়নি, সেই ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই। একটা শিক্ষা কার্যক্রম পর্যালোচনা কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটি বাতিল হয়েছে। কারণ সেই কমিটির একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বৈচিত্র্যের অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন। অথচ সেই ব্যক্তি আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অংশীদার। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে বাদ দেওয়ার দাবির কাছে নতিস্বীকার করে সেই কমিশন বাতিল করেছে। কেউ প্রতিবাদ করেনি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অধিকার আদায়ের আন্দোলন সবাইকে মিলে করতে হবে। ৫ আগস্ট একটি মাইলফলক। নতুন বাংলাদেশের ব্যানার ধরে যারা আছেন, তাদের এজেন্ডা কিংবা চাহিদা একই রকম নয়। একের চাহিদা কি অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে?
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যারা নিজেদের বিজয়ী ভাবছেন, মনে করছেন ক্ষমতায় এসে গেছেন– তাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনা ধারণের কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, এই সরকার মানুষের সমর্থনে গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই সরকার কেন আন্দোলনে বিচ্যুত হওয়ার সব অপচেষ্টাকে প্রতিহত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না– এ দাবি তুলতে হবে। বৈশ্বিক মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে প্রভাবমুক্ত একটি দুদক করা হলেও ভূমিকা পালন করতে পারবে না। রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত এটা সম্ভব নয়।