সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান আবারও ‘গভীর জলে’

.
হাসনাইন ইমতিয়াজ
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:২৫ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৫৭
দেশের গ্যাস সংকট সমাধানের অন্যতম ভরসা হিসেবে দেখা হয় বঙ্গোপসাগরকে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার গত এক দশকেও এই অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। বহু পথ পেরিয়ে গত মার্চে আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডেকেছিল পেট্রোবাংলা। সাতটি বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানি (আইওসি) দরপত্রের নথি কিনেছিল শুরুতে। পরে তিন মাস সময় বাড়ানো হলে গতকাল শেষ সময়েও কোনো দরপত্র জমা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর ফলে দেশের সমুদ্রভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম আরেক দফা পিছিয়ে গেল। দর প্রক্রিয়ায় কোনো বিদেশি কোম্পানির অংশ না নেওয়াকে জ্বালানি খাতের জন্য দুঃসংবাদ হিসেবে দেখছেন তারা, যা সংকটে থাকা দেশের জ্বালানি খাতকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। ব্যয়বহুল এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে।
মডেল পিএসসি ও দরপত্র
সাগরে চারটি বিদেশি কোম্পানি কাজ শুরু করলেও তিনটি ছেড়ে গেছে সময়ের আগেই। এখন শুধু ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি অগভীর সমুদ্রের দুটো ব্লকে কাজ করছে। ২০১২ সালে ভারত ও ২০১৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এর পরও সেভাবে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। এর মধ্যে একাধিকবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তেমন সাড়া মেলেনি।
সবশেষ দরপত্র ডাকা হয়েছিল ২০১৬ সালে। এর পর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি। পরে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে এই মডেল পিএসসি সংশোধন করা হয়। নতুন মডেল পিএসসিতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ড ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান। এখন তেলের দাম ৭০ থেকে ৭২ ডলার। এতে গ্যাসের দাম হবে ৭ থেকে ৭ দশমিক ২ ডলার। দরপত্র ডাকার সময় তেলের দাম ছিল ৯০ ডলারের বেশি।
ছয় মাস সময় দিয়ে গত ১০ মার্চ দরপত্র আহ্বান করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। দরপত্রে অংশ নিতে ৫৫টি কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সে সময়। সেপ্টেম্বরে সময় শেষ হওয়ার আগেই নতুন করে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি এবং ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল শেভরন, এক্সনমবিল, ইনপেক্স, সিনুক ও জোগোম্যাক। শেষ পর্যন্তু তাদের কেউ আসেনি দরপত্রে।
কেন এলো না
খাত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দম কমে যাওয়ার কারণেই আইওসিগুলো দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহী হয়নি। অনেকে মনে করছেন, বঙ্গোপসাগরের খনিজ সম্পদ নিয়ে যে প্রাথমিক তথ্য রয়েছে, তা হয়তো বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, কেউ দরপত্র জমা দিল না কেন– এটা বেশ অবাক করার বিষয়। হয়তো বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে আস্থা রাখতে পারেনি। তবে এটাই একমাত্র কারণ, তা হয়তো নয়। আরও কিছু থাকতে পারে।
এ বিষয়ে শেভরনের কমিউনিকেশন মানেজার শেখ জাহিদুর রহমান এ জাতীয় কারিগরি বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার জানিয়েছেন, দরপত্রে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি। একটা কমিটি করা হবে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য। তারা সংশ্লিষ্ট বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসবে।
এলএনজি নির্ভরশীলতা বাড়বে
দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাসের সংকট চলে আসছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে ২৭৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাস ১৯০ কোটি ঘনফুট। আমদানি করা এলএনজি ৮৫ কোটি ঘনফুট।
দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন দিন দিন কমছে। আগামী দিনে গ্যাসের চাহিদা পূরণে পেট্রোবাংলার অন্যতম ভরসা সমুদ্রের ব্লকগুলো। কিন্তু এখনও অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়নি। ২০৩০ সালের মধ্যে এখান থেকে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে ঘাটতি মেটাতে এলএনজি আমদানি বাড়াতে হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গত ৫ বছরে এ খাতে ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, সাগরে তেল-গ্যাস পাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। জ্বালানি সংকট মেটাতে এই গ্যাস খুবই জরুরি।