আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস আজ
‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হয়ে ছিল মানবাধিকার কমিশন

প্রতীকী ছবি
ওয়াকিল আহমেদ হিরন
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:২৬ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৫১
কাগজ-কলমে স্বায়ত্তশাসিত, আদতে নখদন্তহীন। প্রতিবারই তদবিরে নিয়োগ পান সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরা, আর দুর্বল আইন তো রয়েছেই। এভাবেই ১৬ বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ছিল ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। এক কানাকড়িও মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি সংস্থাটি।
জনগণের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আবির্ভাব। ২০০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই কমিশনের যাত্রা শুরু হয়। পরে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই সংসদে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন পাস হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮ সালে কমিশনের যাত্রা শুরুর পর আওয়ামী লীগ সরকার সব ক্ষমতা হাতে রেখে প্রতিবারই ‘পুতুল’ কমিশন গঠন করে। ফলে সংস্থাটি বছরের পর বছর কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
গেল ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও মানবাধিকার কমিশনকে সক্রিয় করতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। উল্টো চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমেদসহ পাঁচ সদস্যের কমিশন গত ৭ নভেম্বর পদত্যাগ করে। ওই সব পদ এখনও পূরণ করা যায়নি। ফলে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি এখন পুরোপুরি অকার্যকর।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। তবে সংস্কারের তালিকায় নেই মানবাধিকার কমিশন। যদিও কয়েক দশক ধরেই দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তর অভিযোগ করে আসছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহার করে এসব মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে বলে আলোচনা আছে।
চার মাস আগে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনই ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সরকারবিরোধীদের বড় অভিযোগ। এ পটভূমিতে আজ মঙ্গলবার নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ– এখনই’। তবে কমিশন পুনর্গঠন না হওয়ায় সরকারিভাবে কোনো কর্মসূচি নেই।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, জাতিসংঘে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মানবাধিকার কমিশন সব সময় সচল থাকতে হবে। পদ কখনোই খালি রাখা যাবে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার শূন্য পদে নিয়োগ না দিয়ে সংস্থাটিকে গুরুত্বহীন করে রেখেছে।
অবশ্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের জন্য গঠিত স্পিকারের নেতৃত্বে বাছাই (সার্চ) কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠানোর বিধান রয়েছে। এরপর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়ে থাকে। তবে দেশে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার থাকায় সে ব্যবস্থা কার্যত নেই।
এরই মধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া গত ২০ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পর আর কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ নভেম্বরের পর আসা ২৭৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। বর্তমানে কমিশন সচল না থাকায় এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ফলে বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ বাড়ছে। অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য রাজধানীর কারওয়ান বাজার কমিশন কার্যালয়ে রয়েছে আলাদা দুটি বেঞ্চ। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এখন কার্যকর না থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। অন্য বেঞ্চের প্রধান হলেন কমিশনের একজন সার্বক্ষণিক সদস্য। এখন তিনিও নেই। ফলে অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়ে কোনো বেঞ্চ কাজ করছে না।
এ ব্যাপারে কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, একটা কমিশনের চেয়ারম্যান-সদস্যের পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই শূন্য পদে নিয়োগ দিতে হয়। একদিনের জন্য পদ ফাঁকা রাখা উচিত নয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বলেন, কয়েক বছর ধরে কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় ভালো কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিরোধ করবে, এরও কোনো তৎপরতা নেই। তিনি বলেন, দেশে মানবাধিকার কমিশন আছে কি নেই, তা দৃশ্যমান নয়।
১৬ বছরেও দাঁড়াতে পারেনি কমিশন
১৬ বছর আগে কমিশন প্রতিষ্ঠিত হলেও কেন সংস্থাটি এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি– এমন প্রশ্নে সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, কমিশনকে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা যাবে না। গুম-খুনের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। সম্প্রতি গঠিত গুম কমিশনকে তদন্তের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি; এখানেই বৈষম্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তবে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কমিশনকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে আরও সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরেক সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, কমিশন কার্যকর না হওয়ার বড় কারণ দুর্বল আইন ও আমলানির্ভরতা। কমিশনের আইনকে শক্তিশালী করতে হবে, চেয়ারম্যান-সদস্যদের কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। পরমুখাপেক্ষী হওয়া যাবে না। কারণ, কমিশনে পুলিশের বিরুদ্ধেই বেশি অভিযোগ আসে। রাষ্ট্র যে মানুষকে জোর করে আটকিয়ে রাখে, অত্যাচার-নির্য়াতন করে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। এসব করলেই কমিশন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে।
মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ১৬ বছর দেশে স্বৈরতন্ত্র চরমভাবে বলবৎ ছিল। কমিশনে যাদের চেয়ারম্যান-মেম্বার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তারা সরকারের আজ্ঞাবহ ছিলেন। সরকারের সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের মেরুদণ্ড শক্ত ছিল না। তাই এবার দেখে-শুনে-বুঝে নিয়োগ দিতে হবে।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার অনেক আইন করেছে। তবে তা নিজের হাতে মূল ক্ষমতা রেখেই করেছে। তাতে করে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়নি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এর মধ্যে একটি।
তিনি বলেন, প্রতিবেদন দেওয়া ছাড়া এই কমিশনের আর কোনো ক্ষমতা নেই। সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে আইন সংশোধন করতে হবে। আমরা নখদন্তহীন কমিশন দেখতে চাই না। কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে।