‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ কর্মকর্তাকে পদমর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে
জনপ্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সচিব

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মোখলেস উর রহমান অফিসের সামনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবস্থান। ছবি: সংগৃহীত
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:৫২ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৬:৪৩
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বঞ্চিত সরকারি ৭৬৪ সাবেক কর্মকর্তাকে পদমর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে এসব কর্মকর্তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ পদোন্নতির সুপারিশ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত পর্যালোচনা কমিটি।
আজ রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মোখলেস উর রহমান এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান। সচিবালয়ে জনপ্রশাসন সচিব যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তার কার্যালয়ের সামনে বারান্দায় বেশ কিছুসংখ্যক বঞ্চিত কর্মকর্তা দাবি আদায়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলেন।
জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, ‘চাকরি যারা করেন, তারা জানেন, ন্যুনতম একটি প্রক্রিয়ার ব্যাপার আছে। এ বিষয়ে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের একটি নির্দেশনা লাগবে। তবে ইতিবাচক। চাকরির কিছু বিধিবিধান আছে। এটি মানতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ তবে সংক্ষিপ্ত সময়ে এ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
জনপ্রশাসনের সচিব বলেন, ‘এটি ঠিক পদোন্নতি না। এটি হলো সামাজিক মান–মর্যাদা। আর্থিক সুবিধা ও পদ-পদবি দিয়ে একটি সরকারি আদেশ জারি হবে। এর ভিত্তিতে অর্থনৈতিক আদেশে তারা এই টাকা পাবেন। সরকার নীতিগতভাবে একমত। একটু সময়ের ব্যাপার।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সচিব বলেন, ‘পদে বসানো এক বিষয় আর পদমর্যাদা এক বিষয়। এটি হলো ওই পদে মর্যাদা দিয়ে সরকারি আদেশ দেওয়া হবে। হিসাবটি করবে এজি অফিস। তাদের বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম আছে।’ পেনশনের ক্ষেত্রেও এই সুবিধা হবে বলে জানান সচিব।
এর আগে গত মঙ্গলবার ১১৯ জনকে সচিব, ৪১ জনকে সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১ পদ, ৫২৮ জনকে অতিরিক্ত সচিব, ৭২ জনকে যুগ্ম সচিব এবং চারজনকে উপসচিব পদমর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করে পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা কমিটি।
কমিটি প্রধান জাকির আহমেদ খান প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেন।
এদিকে প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। এর পরদিন থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’। আজও তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিরে কক্ষের সামনে অবস্থান নেন।
জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বঞ্চিত দাবি করে ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এর মধ্যে মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে তাদের পরিবারের সদস্যদের করা ১৯টি আবেদনও ছিল। এ পটভূমিতে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গত ১৬ সেপ্টেম্বর ৯০ দিন সময় বেঁধে দিয়ে পাঁচ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক অর্থ সচিব জাকির আহমেদ খানকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়।
নানা কারণে ১৩টি আবেদন কমিটির আওতার বাইরে রাখা হয়। ফলে বাকি ১ হাজার ৫২৭টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে তৈরি করা হয় সুপারিশ। আবেদন বিচার-বিশ্লেষণ করতে কমিটি ২৮ বার সভায় বসে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা ৭৬৪ কর্মকর্তার মধ্যে কমিটি ৯ জনকে চার ধাপ, ৩৪ জনকে তিন ধাপ, ১২৬ জনকে দুই ধাপ ও ৫৯৫ জনকে এক ধাপ পদোন্নতির সুপারিশ করেছে।
অন্যদিকে, আবেদনকারী ৭৬৩ কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করেনি কমিটি। তাদের কেন পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়নি, এর সুনির্দিষ্ট কারণও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে এ বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জানা যায়নি।
একসঙ্গে এত কর্মকর্তাকে ভূতপূর্ব পদোন্নতি দিলে সরকারের কত টাকা খরচ হবে– জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, এসব এখনও হিসাব হয়নি। কারণ, ৭৬৪ জনের জন্য সুপারিশ করা হলেও সরকার কতজনকে এ সুবিধা দেবে, তা এখনও চূড়ান্ত নয়। তিনি জানান, চূড়ান্ত হওয়ার পর কত টাকা খরচ হবে, তা অর্থ মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার। গত ১৮ আগস্ট একসঙ্গে ২০১ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। তারও আগে ১৩ আগস্ট উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ১১৭ কর্মকর্তা। যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের পাশাপাশি গত ২৫ আগস্ট অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩১ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কমিটির পক্ষ থেকে শুধু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে। অতীতের কোনো তারিখ থেকে কোনো বিষয় কার্যকর করা হলে সেটাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ বলা হয়। এসব কর্মকর্তাকে প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে পদায়ন করা হবে কিনা, তা নিয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি।
কমিটির এক সদস্য জানান, আবেদনকারী কর্মকর্তার অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে চুক্তিভিত্তিক পদায়ন পেতে উন্মুখ হয়ে আছেন। এ বিষয়ে সুপারিশ করার এখতিয়ার আমাদের কমিটির ছিল না। তাই আমরা শুধু ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করেছি। এটি বাস্তবায়ন করতে সরকার বাধ্য নয়। এর মধ্যে সরকার যাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিতে চায়, দিতে পারে। চাইলে কাউকে কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দিতে পারে। এটা সম্পূর্ণ সরকারের এখতিয়ার।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাড়ে ১৫ বছরে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা ও যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। যারা পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, পদোন্নতি পাননি, তাদের বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমেও প্রতিবেদন নেওয়া হয়। সেই প্রতিবেদন নেতিবাচক না হলে তাদের বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।
- বিষয় :
- আওয়ামী লীগ
- আর্থিক সুবিধা
- সরকারি কর্মকর্তা