ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ কর্মকর্তা পদের সঙ্গে পাবেন আর্থিক সুবিধা

‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ কর্মকর্তা পদের সঙ্গে পাবেন আর্থিক সুবিধা

কোলাজ

 বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১৯

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ কর্মকর্তাকে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পদমর্যাদা এবং আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য সরকারের এককালীন খরচ হবে অন্তত ৬৮ কোটি টাকা। অবসরে যাওয়া  এত  সরকারি কর্মকর্তাকে একসঙ্গে এভাবে পদমর্যাদা আর আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম। এসব কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ায় তাদের দেওয়া হবে ‘ভূতাপেক্ষ’ পদোন্নতি। এই পদোন্নতি নিয়ে রয়েছে নানামুখী আলোচনা।

প্রশাসন বিশ্লেষকের কেউ কেউ মনে করেন, সততা ও দক্ষতা বিবেচনায় নিয়ে দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তা, যারা বঞ্চিত হয়েছেন শুধু তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিলে সেটা ইতিবাচক হতো।
কেউ কেউ বলছেন, ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি হলেও যে সময়টুকু তারা কাজ করেননি, সে সময়ের জন্য আর্থিক সুবিধা দিলে প্রশ্ন উঠবে। এ ছাড়া এ ধরনের সুযোগ একবার দিলে ভবিষ্যতে এটিকে উদাহরণ টেনে অপব্যবহারের সুযোগও তৈরি হতে পারে।

এদিকে, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে গতকাল রোববারও সচিবালয়ের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ছিল উত্তপ্ত। এক পর্যায়ে তাদের তোপের মুখে পড়েন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। 

৭৬৪ কর্মকর্তার মধ্যে সচিব পদে ১১৯ জন, গ্রেড-১ (সচিবের সমান বেতন গ্রেড) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ কর্মকর্তা রয়েছেন। পর্যালোচনা কমিটি ৯ জনকে ৪ ধাপ, ৩৪ জনকে ৩ ধাপ, ১২৬ জনকে ২ ধাপ এবং ৫৯৫ জনকে ১ ধাপ পদোন্নতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। 

গত ১০ ডিসেম্বর পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা কমিটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন পেশ করে। 
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিবেদনটি এখনও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে মন্ত্রণালয়ে ফেরত আসেনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আসার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে পদমর্যাদার ভিত্তিতে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি হবে।  

প্রজ্ঞাপন জারির পর সংশ্লিষ্ট অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের নতুন পদবি ব্যবহার করতে পারবেন। পদ অনুযায়ী আর্থিক সুবিধাও পাবেন।  
সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, যারা বঞ্চিত তাদের বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। এটাও সত্যি, প্রশাসনে এখনও শৃঙ্খলা ফেরেনি। ফলে যে যেভাবে পারছে নানা দাবি নিয়ে সামনে আসছে, যেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, সৎ, যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি পাননি, তাদের বাছাই করে পদোন্নতি দিতে পারলে প্রশাসনের জন্য ভালো। যারা বঞ্চিত হয়েছেন, এর পেছনে কিছু রাজনৈতিক কারণ তো আছেই। তবে অধিকাংশই ছিল নিরপেক্ষ, যারা গত সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেনি। এখন তারা পদোন্নতি পেয়ে ফিরে আসলে ভবিষ্যতের সরকারগুলোর সময়ে লেজুড়বৃত্তি কমবে। 

জনপ্রশাসন সচিব যা বললেন
সচিবালয়ে গতকাল  জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ৭৬৪ কর্মকর্তাকে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পদমর্যাদা এবং আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমি নিজেও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের নিরসন কমিটির একজন আবেদনকারী। 
তিনি বলেন, কমিটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে। যারা পেয়েছে, কী কারণে পেয়েছে; যারা পায়নি কী কারণে পায়নি– তা উল্লেখ রয়েছে।

কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ৭৬৪ জনকেই পদোন্নতি দেওয়া হবে কিনা– এ প্রশ্নে সচিব বলেন, তাদের মান-মর্যাদা দেওয়া হবে। ঠিক পদোন্নতি নয়। তাদের একটা পদ-পদবি দিয়ে জিও জারি করা হবে। পরে ফিন্যান্সিয়াল জিওর ভিত্তিতে তারা টাকা পাবে। সরকার এ বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত, কিছুটা সময় লাগবে। 
ক্যাডার কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, নিচের কর্মকর্তারা কি সরকারের অংশ নয়– এ ব্যাপারে মোখলেস উর রহমান বলেন, ওই কমিটির যে কার্যপরিধি দিয়েছিল, সেটার বাইরে আমার বলা উচিত না। এটা যদি আরও আস্তে আস্তে বাড়ে, আমার মনে হয় বাড়তেই পারে।

দিনভর উত্তপ্ত মন্ত্রণালয়
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার পর ‘বঞ্চিত’ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা সচিবের দপ্তরের সামনে অবস্থান নেন। তাদের অনেকেই মেঝেতে বসে যান, কেউ কেউ শুয়ে পড়েন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জনপ্রশাসন সচিব তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য দপ্তরের বাইরে এলে তোপের মুখে পড়েন। এ সময় কেউ কেউ জনপ্রশাসন সচিবের পদত্যাগ দাবি করেন। 
ওই সময় জনপ্রশাসন সচিব তাদের জানান, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে কোনো নথি আসেনি। নথি আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
এর পরও সচিবের সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলতে থাকেন কর্মকর্তারা। পরে জনপ্রশাসন সচিব নিজের দপ্তরে চলে যান।

বৈষম্যবিরোধী সরকারি কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সমন্বয়ক এ বি এম আব্দুস সাত্তার বলেন, আজকের (রোববার) মধ্যে প্রজ্ঞাপন না হলে আমরা সচিবালয় ছাড়ব না।
কর্মকর্তাদের অবস্থান এবং আজকের মধ্যে প্রজ্ঞাপনের দাবি নিয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, আমরা যারা চাকরি করি, এটা মানতে হবে, এর বাইরে আমাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। 
এটা এসএসবিতে (সুপরিয়র সিলেকশন বোর্ড) উঠবে কিনা– জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, না, এটা এসএসবিতে উঠবে না। এটা ভিন্ন বিষয়।
তিনি বলেন, আমি সরকারের একটা অংশ, সরকারের কাজ করি। মূল বেনিফিটটা পেনশনে হবে, পুরো জীবনভর। তারা পদমর্যাদা পাবেন। এটি একটি জটিল বিষয়। ৫৩ বছরে আমরা এ ধরনের পরিস্থিতি পাইনি।

নতুন কর্মসূচি
এদিকে পদোন্নতিসহ অন্যান্য দাবি-দাওয়া দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবেন প্রশাসনের বঞ্চিত কর্মকর্তারা। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংগঠন বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, মঙ্গলবার সকাল থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ও কেবিনেটের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন তারা। বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরবেন। ওই দিন দাবি নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন না হলে আগামী বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করা হবে। 
আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কয়েকদিন ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন।

 


 

আরও পড়ুন

×