ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

এস আলমের ছেলেসহ ৫৮ জনের নামে মামলা

ইসলামী ব্যাংকের ১০৯২ কোটি টাকা আত্মসাৎ

এস আলমের ছেলেসহ ৫৮ জনের নামে মামলা

আহসানুল আলম

 সমকাল প্রতিবেদক 

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৫ | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:২২

জালিয়াতির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক কর্ণধার এস আলমের ছেলে আহসানুল আলমসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ইয়াছির আরাফাত বাদী হয়ে কমিশনের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলাটি করেন। এজাহারে বলা হয়, জালিয়াতি করে ব্যাংকে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নিয়ে ওই পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। 

দুদকের অনুসন্ধানে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান এস আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামের ১২৫টি ব্যাংক হিসাবে ২২ কোটি টাকার স্থিতি পাওয়া গেছে। দুদকের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের অবকাশকালীন বিচারক ইব্রাহীম মিয়া ওইসব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেন। এই আদেশের ফলে হিসাবগুলো থেকে কোনো টাকা উত্তোলন করা যাবে না। 

গতকাল দুদক মহাপরিচালক ও মুখপাত্র মো. আক্তার হোসেন এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের ওই পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হয়েছে। ১১৫টি ব্যাংক হিসাবের ২২ কোটি টাকা অবরুদ্ধের বিষয়টিও নিশ্চিত করেন মুখপাত্র। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটকারী পলাতক এস আলমের হাত ছিল। দুদক আরও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধান শেষে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে আরও মামলা করা হবে। 

গত ১০ অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী, মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের কাছে ইসলামী ব্যাংকের পাওনা ৯৬৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ ১২৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী ওই কোম্পানির কাছে ব্যাংকের মোট পাওনার পরিমাণ ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা। মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে মুরাদ এন্টারপ্রাইজের নামে এ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

মামলার আসামিরা হলেন– এস আলমের ছেলে ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম, সাবেক পরিচালক ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ডা. তানভীর আহমদ, ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক ড. মো. ফসিউল আলম, কাজী শহীদুল আলম, ড. মো. সিরাজুল করিম, জামাল মোস্তফা চৌধুরী, মো. জয়নাল আবেদীন, সাবেক পরিচালক খুরশীদ উল আলম, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক ড. মোহাম্মদ সালেহ জহুর ও মোহাম্মদ সোলায়মান, পরিচালক মো. কামরুল হাসান ও সাবেক নমিনি পরিচালক সৈয়দ আবু আসাদ। 

এ ছাড়াও রয়েছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা, ইসলামী ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী ও কে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ও চিফ হিউম্যান রিসোর্স অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী ও মোহাম্মদ সাব্বির, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. রেজাউল করিম, বর্তমান উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম, সাবেক এসইভিপি ও এএমডি মো. আলতাফ হোসেন, এসইভিপি জি এম মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন কাদের, আবু ছাঈদ মুহাম্মদ ইদ্রিস ও সাবেক এসইভিপি মোহাম্মদ উল্লাহ, ব্যাংকটির বিনিয়োগ প্রশাসন বিভাগের প্রধান ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফরিদ উদ্দিন, ইসলামী ব্যাংকের কক্সবাজার শাখার ম্যানেজার আমান উল্লাহ, চট্টগ্রামের চাকতাই শাখার সাবেক ম্যানেজার ও বর্তমানের এফএভিপি মোহাম্মদ আলী আজগর, চাকতাই শাখার সাবেক বিনিয়োগ ইনচার্জ খাজা মোহাম্মদ খালেদ, চাকতাই শাখা প্রধান ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মনজুর হাসান, ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জোনের প্রধান মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী এবং দক্ষিণের অপর জোনপ্রধান ও এসইভিপি মিয়া মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ। 

ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন– মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরী, চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন ট্রেড লিংকের মালিক মোহাম্মদ এরশাদ হোসাইন চৌধুরী, বিসমিল্লাহ ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক মোরশেদুল আলম, মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, চেমন ইস্পাত লিমিটেডের পরিচালক মুহা. নজরুল ইসলাম, ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরিফুল ইসলাম চৌধুরী, পরিচালক মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান, রেইনবো করপোরেশনের মালিক রায়হান মাহমুদ চৌধুরী, আনছার এন্টারপ্রাইজের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরী, সোনালী ট্রেডার্সের মালিক সহিদুল আলম, ফেমাস ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক আরশাদুর রহমান চৌধুরী, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের এমডি মো. রাশেদুল আলম, পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর, গ্রিন এক্সপোজ ট্রেডার্সের মালিক এম এ মোনায়েম, কোস্টলাইন ট্রেডিং হাউজের মালিক এরশাদ উদ্দিন, জাস্ট রাইট ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. গিয়াস উদ্দিন, এক্সক্লুসিভ বিজনেস হাউজের মালিক ফেরদৌস আহম্মদ বাপ্পি, এনেক্স বিজনেস কর্নারের মালিক আনোয়ারুল আজম, সেন্ট্রাল পার্ক ট্রেডিং হাউজের মালিক মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম, জুপিটার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ মামুন, চৌধুরী বিজনেস হাউজের মালিক মোহাম্মদ রাসেল চৌধুরী এবং ডিলাক্সিয়াম ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক কাজী মেজবাহ উদ্দিন। 

এজাহারে আরও বলা হয়, ২০২১ সালের নভেম্বরে এস আলম সংশ্লিষ্ট মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম সরোওয়ার চৌধুরী চট্টগ্রামের ইসলামী ব্যাংকের চাকতাই শাখায় ঋণের জন্য আবেদন করেন। পরের মাসে ওই শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই না করে তা অনুমোদন করেন। মিথ্যা তথ্যের ওপর জাল কাগজ তৈরি করে এ ঋণের জন্য আবেদন করে মুরাদ এন্টারপ্রাইজ। এই ঋণ অনুমোদন করা হয়। কোনো প্রকার যাচাই না করেই পূর্বপরিকল্পনা মাফিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ অনুমোদন করেন। প্রথমে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করা হলেও, পরে সেটি ১১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। 

মুরাদ এন্টারপ্রাইজ যে বিনিয়োগের কথা বলে ঋণ নিয়েছিল তা না করে এস আলম তাঁর বিভিন্ন ব্যবসায় ঋণ পরিশোধ করেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন বলে এজাহারে বলা হয়।

গত ২১ আগস্ট এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম ওরফে এস আলমের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দুদক। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এ গ্রুপটি। এরপর বিভিন্ন সময় ব্যাংকটির ঋণ জালিয়াতি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। ইসলামী ব্যাংকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেও ব্যাপক ঋণ জালিয়াতির ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। নিয়ম না মেনে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকটির চট্টগ্রামের তিন শাখা থেকে ৩ হাজার ২৫৭ কোটি ঋণ দেওয়া হয়। দুদকে এ অভিযোগ জমা হওয়ার পর কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদকের উপপরিচালক ইয়াসির আরাফাতকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি দল গঠন করে।

গত ৫ আগস্টের পর ইসলামী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অনুসন্ধান জোরদার করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল করা হয় মামলা। 

অর্থ অবরুদ্ধের জন্য আদালতে দেওয়া দুদকের আবেদনে বলা হয়, এস আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস ও অন্য দেশে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানকালে তাদের নামে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার ১২৫টি হিসাবে জমা ২২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৯ হাজার ১৯১ টাকা রয়েছে।

আরও পড়ুন

×