ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

খুঁড়িয়ে চলছে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি

খুঁড়িয়ে চলছে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি

কোলাজ

 মেসবাহুল হক

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৪৫ | আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৩৯

রাজধানীর হাজারীবাগের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী শরিফুল ইসলাম গত বছরের জানুয়ারিতে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে নিবন্ধন করেন। এর পর থেকে গত জুলাই মাস পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা দিয়েছেন। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আগস্ট থেকে আর চাঁদা দিচ্ছেন না। কর্মসূচিতে চাঁদা দেওয়া শুরু করার পর অন্তত ২০ শতাংশ গ্রাহক বন্ধ করে দিয়েছেন। নতুন করে গ্রাহকও সেভাবে বাড়ছে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুঁড়িয়ে চলছে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে চালু হাওয়া কর্মসূচিটি।

শরিফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি ও তাঁর স্ত্রী দু’জনই প্রগতি স্কিমে নিবন্ধন করেন। মাসিক ২ হাজার টাকা হারে জমা দিতে থাকেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর স্ত্রী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আর চাঁদা দিচ্ছেন না। বন্ধ করে দেওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে প্রচলিত ব্যাংক ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র ও ট্রেজারিতে বিনিয়োগ থেকেও এ কর্মসূচির আর্থিক সুযোগ-সুবিধা অনেক কম।

গত নির্বাচনের আগে জনগণকে তুষ্ট করতে তড়িঘড়ি করে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করে আওয়ামী লীগ সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এত বড় কর্মযজ্ঞ শুরুর আগে যে ধরনের প্রস্তুতির দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাওয়ার কারণে ভালোভাবে পর্যালোচনা ছাড়াই পেনশন কার্যক্রম শুরু করতে সম্মত হন তৎকালীন অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। প্রথম এক মাসে চার স্কিমে গ্রাহক হন ১২ হাজার ৮৮৯ জন। এর পর কয়েক মাস কিছুটা কমলেও ষষ্ঠ মাস থেকে বাড়তে থাকে। চালুর আট মাস পর নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ১ লাখে পৌঁছায়। এর পর গত মে ও জুন মাসেও বিপুলসংখ্যক মানুষ নিবন্ধন করে চাঁদা জমা দেন। এ দুই মাসে ২ লাখেরও বেশি মানুষ এ কর্মসূচিতে যুক্ত হন। এ সময় প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার নতুন গ্রাহক যুক্ত হন। গত জুলাই পর্যন্ত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজারে।

গত জুলাই থেকে কমতে থাকে নতুন গ্রাহক। জুলাই থেকে গত ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচিতে নতুন গ্রাহক হন মাত্র ১২ হাজার ৩৭৮ জন। এর পরের আড়াই মাসেরও বেশি সময়ে অর্থাৎ গতকাল রোববার পর্যন্ত পর্যন্ত নতুন গ্রাহক যুক্ত হন মাত্র ৬৮০ জন। সব মিলিয়ে ২০২৪ সাল শেষে কর্মসূচিতে মোট ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫৮ জন গ্রাহক ১৪৯ কোটি ৩ লাখ টাকার কিছু বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন। অর্থাৎ শেষ আড়াই মাসে প্রতিদিন নতুন গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র আটজনে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালক জানান, সরকারি নির্দেশনায় বাধ্য হয়ে তিনি এ কর্মসূচিতে নিবন্ধন করেছিলেন। অল্প কয়েক মাস চাঁদা দেওয়ার পর এখন আর দিচ্ছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, তাদের যে বেতন কাঠামো, তা দিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়। 

পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে নতুন স্কিম চালু করার ঘোষণা দেওয়া হলেও বাধার মুখে তা কার্যকর করা যায়নি। আগামী জুলাই থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এর আওতায় আনার সিদ্ধান্ত থেকেও পিছিয়ে গেছে সরকার। এদিকে স্কিম পরিচালনার জন্য গঠিত জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বহন করতে হচ্ছে। তাদের জন্য মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন,  পুরো কর্মসূচি ঘিরে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। সেগুলোকে ঠিক না করা গেলে মানুষ খুব বেশি সাড়া দেবে না। সে ক্ষেত্রে অনেক প্রকল্পের মতো এ উদ্যোগটিও সরকারের একটি ব্যর্থ কার্যক্রম হিসেবে চিহ্নিত হবে। তিনি আরও বলেন, বিগত সরকারের আমলে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই খুব তড়িঘড়ি করে কর্মসূচিটি চালু হয়। সে কারণে সুবিধা পাওয়ার বিষয়গুলোও পরিষ্কার ছিল না। 

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা সমকালকে বলেন, আগে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলেও বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছুটা কমেছে। তবে এর সুফল জনগণের সামনে তুলে ধরতে প্রচারণার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। গত ১৪ অক্টোবর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভায় অংশগ্রহণ বাড়াতে বিধিমালা পরিবর্তন করে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ সিদ্ধান্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরই মধ্যে নির্বাহী চেয়ারম্যান পরিবর্তন হয়েছে। তাই সেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে সেগুলোর কাজ চলছে।

কোন ধরনের পরিবর্তন আনা হতে পারে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বর্তমানে চাঁদার সঙ্গে কোনো ইন্স্যুরেন্সের সংযোগ নেই। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা আছে। বীমা সুবিধা অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, একজন শ্রমিক দুর্ঘটনায় পড়লে তার তো চাঁদা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তবে ইন্স্যুরেন্স থাকলে সে হয়তো সেখান থেকে সুবিধাটা পাবে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেনশন পাওয়ার বয়স বাড়ায়। এ রকম পরিবর্তনও আসতে পারে।

আরও পড়ুন

×