ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অল্প সময়ে অনেক দুর্নাম, এক দিনে প্রত্যাহার চার এসপি

অল্প সময়ে অনেক দুর্নাম, এক দিনে প্রত্যাহার চার এসপি

কোলাজ

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:১৭ | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৭:৩৯

হঠাৎ করেই চার জেলার পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। জেলা পুলিশের পরবর্তী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের আজ মঙ্গলবারের মধ্যে ঢাকায় পুলিশ সদরদপ্তরে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। গতকাল সোমবার পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ, নীলফামারী ও যশোর জেলার এসপির বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হলো। 

পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এমন নির্দেশনার অর্থ হলো তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া। গুরুতর অভিযোগ উঠলে এমন প্রক্রিয়ায় প্রত্যাহার করা হয়।  চার এসপি হলেন– কক্সবাজারের মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ, যশোরের মো. জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ, নীলফামারীর মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম ও সুনামগঞ্জের আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান।

এ ব্যাপারে পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র ইনামুল হক সাগর বলেন, চার জেলার এসপিকে পুলিশ সদরদপ্তরে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে।  

সুনামগঞ্জের এসপি আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা। ৮ সেপ্টেম্বর এই জেলায় এসপি হিসেবে যোগদান করেছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযাগ ওঠে।  প্রথম প্রকাশ্যে অভিযোগ ওঠে গত ২৮ অক্টোবর। সুনামগঞ্জ শহরের শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তনে ‘বালু-পাথর মহাল নিয়ে জনতার ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা এসপির সামনে তাঁর মদদে ধোপাজান বালু-পাথর মহাল লুট হওয়ার অভিযোগ তোলেন। তাঁর অপসারণও দাবি করেন। পুলিশ সুপার ওই মহালের বালুখেকোদের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করেন বলেও এই অনুষ্ঠানে অভিযোগ জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুনামগঞ্জ ও সিলেটের নেতারা।

এই অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ও আইনজীবী নেতারা তাঁকে ইঙ্গিত করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় ধোপাজান বালুমহাল থেকে ৫ আগস্টের পর অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত দেড়শ কোটি টাকার সম্পদ লুট হয়েছে। জেলা প্রশাসন এসব রক্ষা করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে বলেও সাংবাদিক ও আইনজীবী নেতারা উল্লেখ করেন।

এ ছাড়া ওসি পদায়ন, থানা-ফাঁড়িতে এসআই, এএসআই বদলিতে বিশেষ ক্যাশিয়ার ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত যশোর এসপি অফিসে কর্মরত এক স্টেনোগ্রাফার সুনামগঞ্জে এটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা কমিটির আহ্বায়ক ইমনুদ্দোজা বলেন, পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান যোগদানের পরই প্রথম যে অনিয়মটি করেন, সেটি হচ্ছে শহরতলির ইজারা না হওয়া ধোপাজান বালুমহাল লুটপাটে সহযোগিতা করেন প্রকাশ্যে উৎকোচ আদায় করে। 
এ ছাড়া স্যার না বলে সাহেব বলায় খেপে যান এসপি আনোয়ার হোসেন। তাঁর উত্তেজিত হওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় এ ঘটনা ঘটে।

এসপি আনোয়ার বলেন, ‘আমি আজ চাকরি ছাড়লে কালই নির্বাচন করতে পারব। বিএনপির বড় বড় নেতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে।’ একপর্যায়ে এসপি উত্তেজিত হয়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতা এম এস মাসুম আহমদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তাঁকে গলা ধরে বের করে দিতে বলেন। গতকাল সন্ধ্যায় এ ব্যাপারে জানার জন্য পুলিশ সুপারের সরকারি নম্বরে ফোন দিলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে সাড়ে তিন লাখ পিস ইয়াবা মিলেমিশে বিক্রি করার অভিযোগ ওঠার পর পরই কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে একই ঘটনায় নাম আসা ডিবির ওসি জাহাঙ্গীর আলমসহ অন্য সাত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ সমকালকে জানিয়েছেন, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত অন্য পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। 

গত ৮ সেপ্টম্বর মো. রহমত উল্লাহ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। এর পর থেকে জেলায় পুলিশের মধ্যে নিজস্ব বলয় তৈরি করা শুরু করেন। ৬ জানুয়ারি ভোরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ইয়াবা প্রবেশের অন্যতম রুট হিসেবে পরিচিত রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ টয়োটা কোম্পানির ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়ি (নম্বর: ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৬২০৯) জব্দ করা হয়। এ সময় গাড়িতে থাকা চারজনকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা শাখার ওসি জাহাঙ্গীর আলম ও এসআই সমীর গুহের নেতৃত্বে ডিবির একটি আভিযানিক টিম। তবে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে তাৎক্ষণিক তিন ইয়াবা কারবারিকে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে সেখানে। গুরুতর এ অপরাধ আড়াল করতে অভিযানে দেখানো হয় চকরিয়া থানাধীন ডুলাহাজারার ইউনিয়ন। সেখানে ১ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা জব্দ এবং ইয়াবা বহনকারী গাড়ির চালক ইসমাইলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে চকরিয়া থানায় একটি মামলা করা হয় (মামলা নম্বর-১৬)। মামলার বাদী করা হয় এসআই সমীর গুহকে। নিয়ম অনুযায়ী জব্দ করা গাড়ি চকরিয়া থানায় হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু তা না করে জেলা পুলিশ লাইন্সে এনে রাখা হয়। সূত্র জানিয়েছে, ইয়াবা আত্মসাতের পুরো ঘটনা পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহর সঙ্গে কথা বলে করা হয়েছে। তবে এ ঘটনা থেকে মাত্র ৩০ লাখ টাকা পেয়েছেন রহমত উল্লাহ।

মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত থাকলেও দেশটি থেকে বাংলাদেশে গরু-মহিষ চোরাচালান থামছে না। কক্সবাজারের রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির ভালোবাসা, কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, হাজিরপাড়া, মৌলভীরকাটাসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে শত শত গরু-মহিষ। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার আশ্বাসে মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিটি গরুর বিপরীতে এক হাজার টাকা পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করা গড়ে তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ গরু থেকে চাঁদা নেওয়া হয় ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাসে এক কোটি টাকা শুধু গরু চোরাচালান থেকে আদায় হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে এ টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছেন পুলিশের নিজস্ব কয়েকজন সোর্স। তাদের তদারকি করে গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ি। 

প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহ বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য কিনা আপনার কী মনে হয়?’ 
যোগদানের সাড়ে ছয় মাস পর প্রত্যাহার হলেন যশোরের পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহমেদ। 

তবে তাঁকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহারের কারণ হিসেবে নানা বিষয় আলোচনায় উঠে আসছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত গত রোববার মণিরামপুর থানায় গ্রেপ্তার আসামিদের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট হামলা, ভাঙচুর, মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা। এ ছাড়া জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং অপ্রতিরোধ্য স্বর্ণ চোরাচালানকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে যশোরের মানুষ।

২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট যশোরের পুলিশ সুপার পদে যোগদান করেন ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার জিয়াউদ্দীন আহমেদ। তাঁর মেয়াদে যশোর জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চাঁদাবাজি, খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনায় জনজীবনে আতঙ্ক নেমে এসেছে।

একই সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসতে থাকে। সর্বশেষ রোববার মনিরামপুরে মাদকসহ ৪ আসামি ধরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় মনিরামপুর থানার ওসিসহ কয়েকজন উপপরিদর্শকের অপসারণ দাবি করে মনিরামপুর থানার ফটকে বিক্ষোভ করে উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। থানা ঘেরাওকালে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ আসামিদের ধরে আনছে ঠিকই, কিন্তু রহস্যজনক কারণে আদালতে সোপর্দ না করে থানা থেকেই ছেড়ে দিচ্ছে। চিহ্নিত অপরাধী হওয়ার পরও তাদের ছেড়ে দেওয়া ফ্যাসিস্টদের সহযোগিতার নামান্তর। এসবের নেপথ্যে পুলিশের অর্থ বাণিজ্য জড়িত বলে তারা দাবি করেন। 

এ ছাড়া গত বছরের জুলাই মাস থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত যশোরে অর্ধশতাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর আসামি বা হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলেও হত্যা প্রতিরোধ করতে পারেনি। এ ছাড়া গত সাড়ে ছয় মাসে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যশোরে ১৫টি দুর্ধর্ষ ডাকাতি, অন্তত ৩০টি দুঃসাহসিক চুরির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় একটিরও কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। উদ্ধার হয়নি লুণ্ঠিত টাকা ও মালপত্র। এতে দিন দিন আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত জেলা শহরে চুরি, ছিনতাই ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যার পর অনেক সচেতন বাসিন্দা বাইরে বের হতে আতঙ্কিত বোধ করেন। সব মিলিয়ে যশোরে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিগত কয়েক মাসে যশোর সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়েছে। এই স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে পুলিশ চুক্তিবদ্ধ হয়ে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে বলে অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বিষয়টি বেরিয়ে এলে তা অবহিত করা হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহারের পেছনে এটিও একটি কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে সূত্রটির দাবি। 

যশোর পৌর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও বাম নেতা জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, যশোরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। প্রায় প্রতিদিন ছুরিকাঘাত, ডাকাতি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। দখলবাজি হয়েছে। অনেক ডাকাতি হলেও গণমাধ্যমের সূত্রে জানতে পেরেছি, কোনোটার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে  বিশেষ মতাদর্শের লোকদের বসানো হচ্ছে। আমরা ধারণা করছি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়ার কারণে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

নীলফামারী জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলমকেও সোমবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি এ জেলায় যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন অনিয়ম ও অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অবনতির দিকে। জেলায় চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। এসব কারণে তাঁর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সর্বমহলে সমালোচনা শুরু হয়।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন যশোর অফিস, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ ও নীলফামারী প্রতিনিধি)

আরও পড়ুন

×