সহজে সমাধানের যোগ্য বিষয়ই সম্পর্ক উন্নয়নের চাবি

ব্যাংককে ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি বৈঠক হয়। ছবি: সংগৃহীত
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:১৭ | আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৫ | ১২:৫৫
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত। এর কোনোটি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন, আবার কিছু বিষয় রয়েছে চলমান প্রক্রিয়ায়। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সহজে সমাধানযোগ্য বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কোন্নয়ন হতে পারে। বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে গত শুক্রবার দুপুরে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বৈঠকে বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
দু’দেশের সম্পর্কের অস্বস্তির বিষয়গুলো নিজ নিজ তরফে বৈঠকে উঠে আসে। ভারতের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতন, জঙ্গিবাদের উত্থান, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া, গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়ন, তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি এবং সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মতপার্থক্য থাকবে, তবু সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে। যেসব জটিল বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে মতের অমিল রয়েছে, তা সমাধানে সময় লাগবে। এ মুহূর্তে সেসব বিষয়ে নজর না দিয়ে আগে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাছাই করতে হবে সহজে সমাধানযোগ্য বিষয়। ‘জঙ্গিবাদের উত্থান ও সংখ্যালঘু নির্যাতন’ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ নিয়ে কাজ করতে পারে বাংলাদেশ। কারণ, ঢাকা বিষয়টিকে ‘অতিরঞ্জিত’ বলছে। বিষয়টি আসলেই যে অতিরঞ্জিত, সে বিষয়ে দিল্লিকে আশ্বস্ত করতে হবে ঢাকাকে। একইভাবে ভারতীয় ভিসা ফের চালু করা, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ অন্যান্য সমাধানযোগ্য বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, চাওয়া-পাওয়া নয়, বৈঠকটি ছিল পরিচিতিমূলক। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এরই মধ্যে দু’দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ হয়েছে। তবে রাজনৈতিক সম্পর্ক এক রকম শীতল ছিল। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় সামনে এসেছে, সম্পর্কে মতপার্থক্য থাকলেও আলোচনার দরকার আছে। তারা সে উপলব্ধি থেকে নিজেদের কথা বলেছেন। আর সেখান থেকে দু’দেশের অবস্থানের বদল হয়েছে বলে মনে হয়নি। তবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সামনের দিকে এ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে করণীয় জানতে চাইলে এম হুমায়ুন কবির বলেন, রাজনৈতিক পর্যায়ে দুই সরকারপ্রধানের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সম্পর্ক সেভাবে এগিয়ে নিতে হবে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগের সুযোগ রয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যথার্থতা অনুধাবন করে যে ধরনের সংলাপ হওয়া উচিত ছিল, ইউনূস-মোদি বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান। সমকালকে তিনি বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে সরকারপ্রধানদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর দু’দেশের সরকারপ্রধান এই প্রথম বৈঠক করেছেন। গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে বড় একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বদল এসেছে। বৈঠকে ড. ইউনূস বাংলাদেশের নানা উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। এর বিপরীতে ভারতের দিক থেকে সরাসরি প্রতিশ্রুতি বা বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বৈঠকে ভারতও তাদের উদ্বেগের বিষয়াদি তুলে ধরে।
বৈঠকটির মাধ্যমে সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদি জনকেন্দ্রিক সম্পর্কের কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে একক কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল নয়, বরং দেশের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলেছেন। যা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার একটি ইঙ্গিত। এখন দেখতে হবে, এটি ভারত বাস্তবায়ন করে কিনা। বৈঠকের পরে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াবে দিল্লি– এমন আশা অধ্যাপক ড. সাহাবের।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান সমকালকে বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করেছে। ভারতের সঙ্গে এ মুহূর্তে কথা বলা প্রয়োজন ছিল, ড. ইউনূস যথার্থভাবে তা করেছেন। সেই সঙ্গে যতটুকু বার্তা পৌঁছানো দরকার ছিল, তা করা গেছে। তবে একটি বৈঠক দিয়ে সম্পর্কের উষ্ণতা নিশ্চিত হবে না। সম্পর্কে বৈরিতা বিরাজমান, আর এটিই বাস্তবতা।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য প্রথম প্রয়োজন ছিল বরফ গলানো। দুই সরকারপ্রধানের বৈঠক দিয়ে বরফ গলেছে। এখান থেকে সম্পর্ক ভালোভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এখন অন্যান্য পর্যায়ে সফর বিনিময় করা উচিত।