মেঘনার সঙ্গে দেখা করতে মন্ত্রণালয়ে বাবার আবেদন
আটকাদেশ কেন অবৈধ নয় : হাইকোর্ট

মেঘনা আলম
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:৪২
মডেল মেঘনা আলমকে পরোয়ানা ও কারণ উল্লেখ না করে আটক এবং ২৪ ঘণ্টার বেশি গোয়েন্দা কার্যালয়ে হেফাজতে রাখা প্রশ্নে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। হেফাজতে রাখা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমতা আইনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তাঁকে দেওয়া আটকাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিচারপতি রাজিক আল জলিল ও বিচারপতি তামান্না রহমান খালিদী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চ গতকাল রোববার এ রুল জারি করেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান, ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
মেঘনা আলমকে আটকের প্রক্রিয়া ও আটকাদেশের বৈধতা নিয়ে তাঁর বাবা বদরুল আলম রিট আবেদন করেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কাজী জাহেদ ইকবাল ও প্রিয়া আহসান চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও জামিলা মমতাজ।
গত বুধবার রাতে মডেল মেঘনা আলমকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরদিন রাতে আদালত তাঁকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিন আটক রাখার আদেশ দেন। তিনি কাশিমপুর কারাগারে আছেন। বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করা মেঘনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। মেঘনার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেতে তাঁর বাবা বদরুল আলম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গতকাল আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, এক কাপড় পরে মেঘনা কারাগারে গেছে। অনুমতি পেলে তিনি কাশিমপুর কারাগারে যাবেন।
সুনির্দিষ্ট কারণ না জানিয়ে মেঘনা আলমের আটকের ঘটনা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। অপরাধে জড়ালে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার না করে তাঁকে কেন বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিতর্কিত ‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন’ বা প্রতিরোধমূলক আটকাদেশ দেওয়া হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। এমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রোববার সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, মেঘনা আলমকে যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে, তা সঠিক হয়নি। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। পুলিশ তদন্ত করছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব শিগগির উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
কাশিমপুর-২ কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. আল মামুন বলেন, স্বজনরা কারাবন্দির পোশাক নিয়ে এলে আমরা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে স্বজনরা দেখা করতে পারবেন।
এদিকে অভিযানের ব্যাপারে ভাটারা থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেপ্তারের দিন আমি অসুস্থ ছিলাম। কী ঘটেছিল তা জানি না। শুধু জানতাম ডিবি একজনকে গ্রেপ্তার করতে আসবে।’
‘দ্রুত মুক্তি চাই’
মেঘনার বাবা বদরুল আলম সমকালকে বলেন, ‘আমার মেয়ে নির্দোষ। সরকার দ্রুত তার মুক্তির ব্যবস্থা করুক। ২০-২৫ জন মিলে যেভাবে দরজা ভেঙে তাকে আটক করা হয়েছে সেটা কোন গণতান্ত্রিক পরিবেশ। মেঘনা ২০১৪ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের (প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে একটি ইয়ং ওয়ার্ল্ড সামিটে অংশ নিতে যায়। তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে বাছাই করা হয়। সেই মেয়ে এখন এত বড় দেশদ্রোহী হয়ে গেল! একটি কালো আইনে তাকে হেফাজতে নেওয়া হলো। তার বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, তিনি কোথায়। অন্যায় করে বিদেশি একজন নাগরিক চলে যাবে এটা হতে পারে না। বিনা দোষে আমার মেয়ে জেলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুরো ঘটনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জটিল করেছেন। তিনি সৌদি আরবের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলানের সঙ্গে মেঘনার দূরত্ব সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। যদিও এক সময় মেঘনার সঙ্গে দুহাইলানের সম্পর্ক তৈরিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা সহযোগিতা করেন।’
ডিবিপ্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হলো
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবার ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের এক আদেশে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এই আদেশে সই করেছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। এতে বলা হয়, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিককে ডিএমপির সদরদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক স্বার্থে রেজাউল করিম মল্লিককে তাঁর নামের পাশে উল্লিখিত স্থানে পদায়ন করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
গত ১ সেপ্টেম্বর ডিএমপির ডিবিপ্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রেজাউল। সূত্র জানায়, ১৭তম বিসিএস (পুলিশ) ব্যাচের কর্মকর্তা রেজাউল ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। ডিএমপির ডিবিপ্রধান হওয়ার আগে তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আটকের নিন্দা
গত বুধবার রাতে পুলিশ আটক করতে গেলে তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে লাইভ করেন মেঘনা। তিনি বলছিলেন, ‘তাঁর দরজার বাইরে পুলিশ পরিচয়ধারীরা তাঁকে নিতে এসেছে। বাসায় কিছু মানুষ আক্রমণ করেছে। তারা নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিচ্ছে। আমি বলেছি থানায় এসে কথা বলব, তারা কথা শুনছে না। দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের কথায় পুলিশ বাসায় এসেছে।’ ১২ মিনিটের বেশি সময় ধরে চলা লাইভটি এর পর ডিলিট হয়ে যায়। ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর মিস আর্থ বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন মেঘনা আলম।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ দেন জেলা প্রশাসক। এটা আদালতের ব্যাপার নয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সমকালকে বলেন, মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট মামলা বা অভিযোগ ছিল না। কোনো ব্যক্তির দরজা ভেঙে বা জোর করে ঘরে ঢুকে গ্রেপ্তার করলে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়। মডেল মেঘনা আলম কোনো সন্ত্রাসী ছিলেন না।
এদিকে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ এক বিবৃতিতে জানায়– রাতের আঁধারে যে কোনো নাগরিকের বাসায় বলপূর্বক প্রবেশ করে কাউকে আটক করা মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। যে আইনে মেঘনাকে আটক করা হয়েছে সেটি নিপীড়নমূলক আইন। এটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার মনে করা হয়।
- বিষয় :
- মেঘনা আলম