বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকারে সমান অধিকারের সুপারিশ

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। শনিবার বিকেলে কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পিআইডি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:১৭ | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ | ০৭:১৩
বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকারের জন্য অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ করেছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। গতকাল শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হকের নেতৃত্বে এ প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রতিবেদন বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন কমিশনের প্রধান ও সদস্যরা।
এ সময় জানানো হয়, প্রতিবেদনে ১৫ মূল বিষয়সহ ৪৩৩টি সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয় এবং কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৬০০ করা এবং সেই আসন থেকে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয় সুপারিশে সংবিধানে পরিবর্তন এনে নারী-পুরুষ সমতার নিশ্চয়তাসহ অভিন্ন পারিবারিক আইন, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন, ধর্ষণ আইন, নাগরিকত্ব আইন, সাক্ষী সুরক্ষা আইনে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা দ্রুত কার্যকরের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, যেসব সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো যেন আমাদের মাধ্যমে হয়ে যায়। আমরা যেন এ কাজের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি। পৃথিবীর মেয়েরা এটির দিকে তাকিয়ে আছে। তারা এটি নিয়ে পর্যালোচনা করবে অনুপ্রাণিত হবে। অন্য দেশের নারীরাও এটি নিয়ে আগ্রহী।
ড. ইউনূস বলেন, এটি শুধু নারীদের বিষয় নয়, সার্বিক বিষয়। এ প্রতিবেদন ছাপিয়ে বিলি করা হবে। এটি পাঠ্যবইয়ের মতো করে ছাপা হবে। দলিল হিসেবে অফিসে রেখে দিলে হবে না, মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনপ্রধান বলেন, আমরা যে নীতি অনুসরণ করেছি, তার প্রথমে রয়েছে বৈষম্যহীনতা। কারণ, এটির শুরুই হয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দিয়ে। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকারের মূল্যবোধ। এর পর আমরা দেখতে চেয়েছি, আমরা কেমন রাষ্ট্র চাই? আমরা ইহজাগতিক, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র দেখতে চাই। আমরা অসাম্প্রদায়িক সমাজ চাই। আমরা যতদূর সম্ভব শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিপার্থক্য দূর করতে চাই।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি, ৪৩৩টি সুপারিশের মধ্যে ২০০টিও যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে অনেক এগিয়ে যাব। অন্তর্বর্তী সরকার এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের করণীয় ছাড়াও সুপারিশে আরেকটি ভাগ রাখা হয়েছে। এটি হচ্ছে নারী আন্দোলনের যে চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা ‘স্বাধীনতা’ এবং সত্যিকার অর্থে সেটি পেতে হলে আমরা কী করতে চাই, আমাদের আকাঙ্ক্ষা কী, স্বপ্ন কী– সেগুলো তুলে ধরেছি।
শিরীন পারভীন হক আরও বলেন, আমরা জানি, অনেক কিছু নিয়ে বিতর্ক হবে। বিতর্ককে স্বাগত জানাই। কারণ আমরা মনে করি, এখন ২০২৫ সাল, হাইটাইম। এগুলো নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা হোক, বিতর্ক হোক, জানাজানি হোক, মানুষ জানুক নারী কী চায়, নারীর স্বপ্ন কী?
অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার
প্রতিবেদনে নারীর অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে, নারীদের সামাজিক ও পারিবারিক ভূমিকা তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এবং অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। খাসজমি বন্দোবস্ত ও বনজ সম্পদে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মৎস্যজীবী হিসেবে নারীদের নিবন্ধনের মাধ্যমে স্বীকৃতি ও সরকারি জলমহাল বন্দোবস্ত নীতিমালা সংস্কার করে জলমহাল ইজারা গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সম্পত্তিতে নারীদের সমান উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করা জরুরি।
আনুষ্ঠানিক খাতে নারীর জন্য অনুকূল কর্মসংস্থান নীতি তৈরি করে প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদান যেমন– শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, কর্মক্ষেত্রের জন্য আচরণবিধি প্রণয়নের মাধ্যমে যৌন হযরানিমুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও সহায়তায় ব্যবসায়িক সংগঠনের ভূমিকা শক্তিশালী এবং নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য ঋণের শর্ত সহজ ও নারীবান্ধব করতে হবে।
নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ব্যবসায়িক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। ই-কমার্সের জন্য একটি আইনগত নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করা এবং ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন ও নবায়ন প্রক্রিয়া সহজ করা প্রয়োজন। শ্রমবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত শিক্ষা প্রদান ও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে যুব নারীদের কর্মসংস্থানে প্রবেশ সহজ করতে হবে। গৃহকর্ম ও পরিচর্যার কাজের বোঝা কমাতে হবে, এটার স্বীকৃতি দিতে হবে এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করতে হবে।
বাল্যবিয়ে কমছে না
মেয়েদের বিয়ের বয়স আইনিভাবে ১৮ বছর হলেও এখনও ৫১ শতাংশের বিয়ে হয় এর আগেই। ফলে কৈশোরকালীন, অনাকাঙ্ক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট গর্ভধারণের ৪৮ শতাংশ অনাকাঙ্ক্ষিত। মাসিক নিয়মিতকরণ সেবা অনুমোদিত হওয়া সত্ত্বেও অনিরাপদ গর্ভপাতের শিকার হয়ে অনেক নারী স্বাস্থ্য ও মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। কমিশন বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭-এর বিশেষ বিধান বাতিল করে মেয়েদের বিয়ের বয়স সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছরের সুপারিশ করেছে।
বর্তমানে দেশে সন্তান প্রসবের ৪০ শতাংশই সি-সেকশনের মাধ্যমে হচ্ছে, যার অনেকটি অপ্রয়োজনীয়। নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন নিয়ন্ত্রণে ২০২৩ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে নীতিমালা প্রণয়ন এবং সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে তা মেনে চলা পরিবীক্ষণ করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
প্রতিবন্ধী নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় অভিগম্যতা কম। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব নয় এবং সেবাদানকারীদের দক্ষতাও সীমিত। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩তে প্রতিবন্ধী নারীদের বিশেষ ঝুঁকি ও প্রান্তিকতা স্বীকার করা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবনচক্রের সব পর্যায়ে নারীর প্রতিরোধমূলক ও নিরাময়মূলক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। অথচ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়ন কৌশল ২০১২-২০৩২-এ নারীদের বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধকতা বিবেচনা করে এ জন্য কোনো বিশেষ পদক্ষেপ রাখা হয়নি।
আদিবাসী নারী
পার্বত্য এলাকার বিস্তৃতির তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র কম। দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আদিবাসী নারীরা, বিশেষত প্রসূতিরা নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন না। প্রত্যন্ত এলাকার জনগোষ্ঠী, বিশেষত আদিবাসী নারী ও মেয়েদের জন্য মাতৃ এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসহ পর্যাপ্ত ও সংবেদনশীল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত; আদিবাসী অঞ্চলের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভাষাগত বাধা দূর করতে দোভাষী নিয়োগ বা স্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দোভাষী হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করেছে কমিশন। একই সঙ্গে আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক নারীকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রণোদনাসহ বিশেষ কর্মসূচির কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নারী আসন
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদে পুরুষের সমান সংখ্যক নারী প্রতিনিধি সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে আসবেন। সংসদীয় আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০টি করতে হবে, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একটি সাধারণ আসন এবং নারীদের জন্য একটি সংরক্ষিত আসন থাকবে। উভয় আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন হবে। উচ্চকক্ষে ৫০ শতাংশ আসনে আনুপাতিক হারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে, তা পুরুষ-নারী পর্যায়ক্রমে জিপার পদ্ধতিতে দিতে হবে। যাতে প্রতিটি দল থেকে সমান সংখ্যক নারী ও পুরুষ মনোনীত হন। উচ্চকক্ষে ৫০ শতাংশ আসনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের প্রতি অনাস্থা প্রকাশে জাতীয় নির্বাচনের ব্যালটে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
যৌনকর্মীদের শ্রমিক স্বীকৃতি
দেশে যৌনকর্মীদের আইনগত স্বীকৃতি নেই। যৌন পেশা সম্পর্কে সুস্থ আইনও নেই। ফলে যৌনকর্মীরা পুলিশের হয়রানি ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হন। আর্থিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে তারা আরও ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি না থাকায় তারা আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তা পান না। প্রতিবেদনে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতির পাশাপাশি তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য মাহীন সুলতান, অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার, কল্পনা আক্তার, হালিদা হানুম আক্তার, সুমাইয়া ইসলাম, নিরুপা দেওয়ান, ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।