আদালতে নূরুল হুদার জবানবন্দি
রাতের ভোটে সহায়তা করেন গোয়েন্দা, পুলিশ ও রিটার্নিং কর্মকর্তারা

সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদা ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে আদালতের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। ছবি: সমকাল
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫ | ০৬:৪৮ | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৫ | ১০:১৫
২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে কীভাবে গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের অতিউৎসাহী কর্মকর্তারা মাঠ দখলে নিয়ে জালিয়াতির ভোট সম্পন্ন করেন, তা জানালেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নূরুল হুদা। তিনি বলেন, পুলিশ ছিল সরকারের অনুগত। এ ছাড়া রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা সরকারের আজ্ঞাবহ ছিলেন। তখন ভোট নিয়ন্ত্রণ করেছিল এনএসআই ও ডিজিএফআই। সহযোগিতায় ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। তারা দিনের ভোট রাতে শেষ করে। আদালতে জবানবন্দিতে এসব তথ্য দেন নূরুল হুদা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন নূরুল হুদা। এর আগে তাঁকে দুই দফা হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন সাবেক সচিব নূরুল হুদা। তিনি ছিলেন দেশের দ্বাদশ সিইসি। তাঁর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হয়।
গতকাল রাতে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পিবিআই উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি এনায়েত হোসেন মান্নান সমকালকে বলেন, ‘এই মামলায় আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক তদন্ত প্রতিবেদন দিতে চাই। ভোটে নানা অনিয়ম ও অসংগতির কথা স্বীকার করেছেন নূরুল হুদা। আমাদের কাছে যখন ছিলেন তখন তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে চেয়েছেন। তাই মঙ্গলবার তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়।’
সাবেক এই সিইসি বলেন, তৎকালীন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের লোক। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তাঁর মাধ্যমে ‘ডিল’ হয়েছে। সরকারের অতিউৎসাহী কর্মকর্তারা এতে সহযোগিতা করেছেন। নির্বাচনের সময় মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা তৎকালীন ইসি সচিব হেলালুদ্দীনের অধীনে ছিলেন। সরকারের হয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন তিনি। নূরুল হুদার একার পক্ষে কিছুই করার ছিল না বলে দাবি করে তিনি বলেন, যারা অন্ধভাবে সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, তারাও জালিয়াতিতে সহযোগিতা করেছে। এটা না হলে ভোট নিয়ে এত বড় জালিয়াতি সম্ভব হতো না। ভোট জালিয়াতিতে অনেক রাজনৈতিক নেতা প্রভাব খাটান। তারা সরাসরি জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে পরে সুবিধাভোগী ছিলেন।
নূরুল হুদা দাবি করেন, নির্বাচন কমিশনারকে অন্ধকারে রেখে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। আর গোয়েন্দা সংস্থা আগে মাঠ দখলে রেখেছিল। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা দিনের ভোট রাতে করতে সহযোগিতা করেছেন।
সাবেক সিইসি নূরুল হুদা বলেন, নির্বাচনের সময় পার হওয়ার পর জানতে পারেন, কোনো কোনো কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। অনেক কেন্দ্রে রাতেই ভোট সম্পন্ন হয়েছে। ভোট নিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। পদত্যাগ করব– এমন পরিস্থিতি ছিল না। ভোটের এমন পরিস্থিতি নিয়ে অনুতপ্ত ছিলাম। যেহেতু গেজেট প্রকাশ হয়ে গেছে, তখন আমি নির্বাচন বাতিল করতে পারি না। তখন আমার হাতে ক্ষমতাও ছিল না। বিষয়টি জানার পর বুঝতে পারি, সব শেষ হয়ে গেছে। তবে ওই পরিস্থিতির জন্য অনুতপ্ত ছিলাম।
তিনি আরও বলেন, তৎকালীন অবৈধ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পূর্ণ সহায়তা করে অবৈধভাবে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মাধ্যমে দিনের ভোট রাতে করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। নির্বাচনে বিভিন্ন সুবিধাভোগী পক্ষ ছিল। তাদের চাপ ছিল। ভোট রাতে হওয়ার পেছনে তারা ভূমিকা রেখেছে।
আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আসামি করে মামলা করে বিএনপি। মামলায় মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। গত ২২ জুন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এ ছাড়া সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার, এ কে এম শহীদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করা হয়েছে এ মামলায়। গত ২৫ জুন এ মামলায় নতুন করে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ধারা যুক্ত করা হয়।
২২ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে নূরুল হুদার বাড়িতে গিয়ে মব তৈরি করে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে করা মামলায় পরদিন তাঁর চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার সিএমএম আদালত। চার দিনের রিমান্ড শেষে আরও চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গত ২৯ জুন একই মামলায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালকে তিন দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়।
এজাহারে বলা হয়, ওই তিন নির্বাচনে ‘গায়েবি মামলা, অপহরণ, গুম-খুন ও নির্যাতন’-এর ভয় দেখিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীকে ‘গণগ্রেপ্তার’ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়।
জামিন হয়নি
বিএনপি নেতার করা মামলায় কে এম নূরুল হুদাকে জামিন দেওয়া হয়নি। বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে নূরুল হুদার জামিন চেয়ে আবেদন করেন তাঁর আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম সজীব। শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করেন।
- বিষয় :
- সিইসি
- সিইসি কে এম নুরুল হুদা