ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

রানা প্লাজা ধসের এক যুগ

ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণের সুপারিশ

ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণের সুপারিশ

ধসে পড়া রানা প্লাজা। ফাইল ছবি

 আবু হেনা মুহিব

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:৩১ | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫ | ০৭:২৭

সাভারে রানা প্লাজাধস-পরবর্তী সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের প্রচেষ্টায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তা শ্রমিক অধিকার ও তাদের অবস্থার উন্নয়নে এবং সামগ্রিকভাবে তাদের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে কী অবদান রেখেছে তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে রানা প্লাজা ধসের প্রসঙ্গ তুলে এই বিশেষ সুপারিশ করেছে। রানা প্লাজার ঘটনায় যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কমিশন তার একটি শ্বেতপত্রও প্রকাশের সুপারিশ করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রানা প্লাজা ধসের ঘটনা এক যুগ পূর্ণ হলো। 

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত সোমবার প্রতিবেদনটি জমা দেয় শ্রম সংস্কার কমিশন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন ১৮ সদস্যের কমিশনের নেতৃত্ব দেন।

২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা নামে একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। চাপা পড়ে ভবনের পাঁচ পোশাক কারখানার এক হাজার ১৩৮ শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন আড়াই হাজার শ্রমিক। এ দুর্ঘটনাকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে মনে করা হয়। 

ওই দুর্ঘটনার পর নিরাপদ কর্মপরিবেশ না থাকার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা জিএসপি স্থগিত করা হয়; যা আর পুনর্বহাল হয়নি। একই সুবিধা স্থগিতের হুঁশিয়ারি আসে ২৭ জাতির জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে। অনেক ব্র্যান্ড-ক্রেতা বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। বাংলাদেশের পোশাক ব্যবহার না করার জন্য বিভিন্ন দেশে মিছিল, প্রচার-প্রচারণায় নামে গ্রিন গ্রোথ ক্যাম্পেইন, ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক অনেক শ্রমিক সংগঠন। 

কমিশনের সুপারিশ

‘শ্রম জগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শিরোনামে শ্রম কমিশনের প্রতিবেদনটিতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাধারণত শিল্প দুর্ঘটনায় হতাহত শ্রমিক পরিবারগুলো ঝামেলা এড়াতে মামলা করতে চায় না। বছরের পর বছর মামলা চললেও কোনো সুরাহা হয় না। এজন্য মামলায় ব্যয়ও একটি বড় বাধা। 

কমিশন প্রকৃত ক্ষতিপূরণের মামলা উৎসাহিত করতে আদালতের ফি রদ করার সুপারিশ করেছে। এতে বলা হয়, ক্ষতিপূরণের শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা হালনাগাদ করে পঙ্গুত্ববরণকারী ও অক্ষম শ্রমিকদের পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। দুর্ঘটনায় আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ক্ষতিপূরণ-সংক্রান্ত একটি তথ্যভান্ডার করে এতে সংশ্লিষ্ট সব তথ্য হালনাগাদ এবং প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। 

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি এবং শ্রম কমিশনের সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন গত বুধবার সমকালকে বলেন, রানা প্লাজা ধসে নিহতদের পরিবার এবং আহত শ্রমিকরা প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পাননি। প্রতিবছর সাভারে রানা প্লাজা ধসের অস্থায়ী বেদি কিংবা জুরাইনে কবরস্থানে শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে এ নিয়ে আহাজারি করতে দেখা যায়। ক্ষতিপূরণের নামে যা পাওয়া গেছে, সেটি আসলে বিশেষ অনুদান। আইএলও, তৈরি পোশাকের ব্র্যান্ড ক্রেতা এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে কিছু অর্থ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র কিংবা মালিকপক্ষ ক্ষতিপূরণ দেয়নি। 

রাজেকুজ্জামান বলেন, আইএলও কনভেনশনের ১২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের পরিমাণ শ্রমিকের বয়স, দক্ষতা ও মজুরির ভিত্তিতে ভিন্ন হতে পারে। তারা পর্যালোচনায় দেখেছেন, রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের গড় বয়স ২৫ বছর। দেশের আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক যদি ৫৯ বছর কাজ করতে পারে তাহলে তাঁর কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। শ্রম আইনে আছে মাত্র দুই লাখ টাকা। 

দুর্ঘটনার পর হাইকোর্ট সুপারিশ করেছিলেন, স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকদের ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। একটি অঙ্গ হারানো শ্রমিকদের সাড়ে সাত লাখ টাকা করে, দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা প্রয়োজন এমন শ্রমিকদের সাড়ে চার লাখ টাকা করে এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দেড় লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল।

ক্ষতিপূরণ বাড়ানোর সুপারিশ

শ্রম কমিশন তাদের সুপারিশে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছে। অন্তত একটি সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দিতে বলেছে তারা। এজন্য একটি মানদণ্ড নির্ধারণের সুপারিশ করেছে কমিশন। বলা হয়েছে, আইএলওর সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ এবং দেশে হাইকোর্টের এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা অনুযায়ী যেন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে ন্যায্য মানদণ্ড নির্ধারণের কথা বলা হয় প্রতিবেদনে। 

জানতে চাইলে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ গতকাল সমকালকে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা অন্যান্য শিল্প খাতে কাজে লাগানো হয়নি। এমন কী ওই দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশের যে সফল উদহারণ তৈরি হয়েছে তা থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি দেশের অন্যান্য শিল্প খাত। এ কারণে চট্টগ্রামে কনটেইনার ডিপো, নারায়ণগঞ্জে হাশেম ফুডের কারখানায়, নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডে ক্ষতিপূরণ পাননি। অনেক দুর্ঘটনার পরে মামলা নেওয়া হয়নি; আর দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসাসেবা পাননি আহত শ্রমিকেরা। তাই ক্ষতিপূরণের একটি স্থায়ী মানদণ্ড নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে। কমিশন টাকার পরিমাণ না বলে ন্যূনতম একটি হার নির্ধারণের সুপারিশ করেছে, যাতে কোনো শ্রমিক এর চেয়ে কম না পায়। 

সর্বোচ্চ ৬১ লাখ, সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেছে

রানা প্লাজা ধসে আহতদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে ট্রাস্ট ফর ইনজুরড ওয়ার্কার্স মেডিকেল কেয়ার (টিআইডব্লিউএমসি) নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয় ২০১৬ সালে। আইএলওর নেতৃত্বে ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা ও অন্যান্য বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা ক্ষতিপূরণ তহবিল থেকে তাদের এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৩ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা হয়েছে। 

তাতে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ৬১ লাখ থেকে সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকা পেয়েছে শ্রমিক এবং তাদের পরিবার। এর মধ্যে দুর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া অনুদানের অর্থ কেটে রাখা হয়। 

ট্রাস্টের সমন্বয়ক শাহরিয়ার রনি সমকালকে জানান, আইএলওর নেতৃত্বে গঠিত ওই তহবিলসংক্রান্ত সব কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে টিআইডব্লিউএমসির মাধ্যমে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় গুরুতর এবং সাধারণ আহত মিলে এক হাজার ৯৮৬ জন শ্রমিককে মোট ২১ হাজার বার চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। 

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ নিয়ে শ্বেতপত্র চায় কমিশন 

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়নের দাবি করেছে কমিশন। এতে বলা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা, তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডসহ উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা-পরবর্তী সরকারি কার্যক্রম, তদন্ত, বিচার, ক্ষতিপূরণ, দেশি-বিদেশি আর্থিক অনুদান ব্যয় সম্পর্কিত একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ফান্ডের ব্যবহৃত অর্থ নিয়েও আলাদা একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের সুপারিশ করেছে কমিশন। 


 


 

আরও পড়ুন

×