অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্মরণ
অর্জনের অভিযাত্রাকে স্বাগত জানাতেন তিনি

বেঙ্গল শিল্পালয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম সমকাল
দ্রোহী তারা
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫ | ০১:০৫
শিক্ষাব্রতী, প্রাবন্ধিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসারে অগ্রণী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র থেকে চোখ সরাতে পারছিলেন না কেউ। এত নান্দনিক ও জ্ঞানী মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষণই একটি বইয়ের পাতার মতো।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ষষ্ঠ প্রয়াণ দিবস ছিল গত ১৪ মে। তাঁকে নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে হয় স্মারক বক্তৃতার আয়োজন। শিরোনাম ছিল ‘উনিশ শতকের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’। এ আয়োজন করে কালি ও কলম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও প্রাবন্ধিক-গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। বক্তাকে পরিচয় করিয়ে দেন কালি ও কলমের সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের পর মোহাম্মদ আজমের বক্তব্যে উঠে আসে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘উনিশ শতকের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থের নানা দিক। বলা হয়, তিনি সেকালের প্রভাবশালী মতামত দ্বারাই মুখ্যত চালিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান কৃতিত্ব হলো, তিনি কেবল সে মতামতের ভোক্তা ছিলেন না, নিজেও তার পোষকতা করেছেন এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভাষার জোগান দিয়েছেন। তাঁর অর্জনের যথার্থ ব্যবহার হবে কেবল তখনই, যখন একে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে আমরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল আর তথ্য-উপাত্তের নিরিখে নতুনতর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব। তার জন্য মনে রাখা দরকার, ইতিহাস-পাঠে ‘সত্যমূলকতা’ তুলনামূলক গৌণ ব্যাপার। কারণ, ইতিহাসে আমরা বস্তুত বর্তমানকেই পাঠ করি। আনিসুজ্জামান তাঁর কালের প্রগতিশীল ও প্রয়োজনীয় ভাবধারা হিসেবে জাতীয়তাবাদ অবলম্বন করেই বয়ান নির্মাণ করেছেন। সেকালের পটভূমিতে জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য উত্তম বিবরণী হাজির করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সে জন্য তিনি পর্যাপ্ত প্রশংসাও পেয়েছেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উদারনৈতিক অবস্থান, আধুনিকতাবাদ এবং প্রগতিশীলতাও বিশেষ স্থান-কালের বাস্তবতা দ্বারাই চালিত হয়। এ প্রতিটি বর্গের সাধারণ সীমাবদ্ধতা এই যে, সুবিধাপ্রাপ্ত তুলনামূলক শিক্ষিত-নাগরিক জনগোষ্ঠীর ভিত্তিতেই এ বর্গগুলো কাজ করে থাকে। আরও বেশি পরিমাণে মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং বিবেচনার গণ্ডিতে আরও অনেক বেশি মানুষকে নিয়ে আসার কথা আমাদের ভাবতে হবে। এটা একদিকে বর্তমান রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে ইতিবাচক অর্থে প্রভাবিত করার মামলা, অন্যদিকে জ্ঞানতাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত নতুন অর্জনগুলোকে আত্মসাৎ করে বয়ানকে তুলনামূলক পূর্ণাঙ্গ করে তোলার অভিযাত্রা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পর্কে যতটা ভাবা যায়, তার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, তিনি এ ধরনের অভিযাত্রাকে নিঃসংকোচে স্বাগত জানাতেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং সর্বশেষ জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বহুবিধ কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি মনীষার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন। কৈশোর-উত্তীর্ণ কাল থেকে তাঁর সামাজিক দায় ও অঙ্গীকার গড়ে উঠেছিল। এই দায়ই তাঁকে সবসময় চালিত করেছে বহুমুখিন সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক ও সামাজিক আন্দোলনকে জোরপ্রবাহিণী করে তুলতে। তাঁর চরিত্র-মাধুর্য, স্বভাবধর্ম ও সৌজন্যে যে বিনয় ছিল এবং সবাইকে ভালোবাসা ও স্নেহ করার যে উজ্জ্বল প্রকাশ ছিল, তা তাঁকে করে তুলেছিল এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বহু লেখক, শিক্ষক, শিল্পী, শিক্ষার্থীকে দেশচেতনায় উদ্দীপিত করেছেন তিনি। জাতীয় ও সামাজিক সংকটকালে তাঁর নেতৃত্বের দায় বহন এ অঞ্চলের বাঙালিকে প্রাণিত করেছে পথ চলতে।
- বিষয় :
- স্মরণ