ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

মানবতাবিরোধী অপরাধ

রায় বাতিল, খালাস পেলেন জামায়াত নেতা আজহার

খালাসের রায়ে চার পর্যবেক্ষণ, মুক্তি পেতে পারেন আজ

রায় বাতিল, খালাস পেলেন জামায়াত নেতা আজহার

এটিএম আজহারুল ইসলাম

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫ | ০১:১৪ | আপডেট: ২৮ মে ২০২৫ | ০৬:৫৭

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম। গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের ছয় ঘটনায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় গতকাল মঙ্গলবার বাতিল করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে এই রায় দেন। ছয় বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আজহারের আপিল শুনে এ রায় দেওয়া হয়। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলে এই প্রথম কেউ খালাস পেলেন।

গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর আজহারুল মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দফা আপিল করেন। প্রথম দফায় ২০১৯ সালে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছিলেন তৎকালীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। আজহারুলের খালাসের রায় ঘোষণার পরপরই গতকাল দুপুরে আপিল বিভাগ থেকে বিচারপতিদের স্বাক্ষর শেষে সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করা হয়। এরপর বিধি অনুযায়ী তাঁর মুক্তির বিষয়ে আদেশ জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

আজহারুল রাজধানীর শাহবাগের বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কয়েক মাস ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল।

আদালতে আজহারুলের আবেদনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক ও আইনজীবী শিশির মনির। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম এবং রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম মাছুমসহ দল ও এর অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে উল্লাস প্রকাশ করেন আজহারের আইনজীবীসহ জামায়াত-সমর্থিত নেতাকর্মীরা। কেউ কেউ নারায়ে তাকবির ধ্বনি দেন। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সমর্থকদের কয়েকজন শোকরানা নামাজ পড়েন।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আজহারের আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষে এ বিষয়ে কেউ বক্তব্য দেয়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লেখেন, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস পেয়েছেন জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম। এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণআন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের।

তবে আজহারুল যুদ্ধাপরাধ মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে উষ্মা প্রকাশ করেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিসহ একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতার বেকসুর খালাস পাওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এ ছাড়া গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মুক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ বামপন্থি কয়েকটি ছাত্র সংগঠন।

রায় ঘোষণার পর আজহারুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা।

রায়ের পর্যবেক্ষণ
আজহারুলকে খালাসের রায়ে আপিল বিভাগ চারটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। প্রথমত, অতীতের রায়ে বাংলাদেশসহ এই ভারতীয় উপমহাদেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল, এটি ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। দ্বিতীয়ত, আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করা ছাড়াই এ টি এম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয়ত, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি ট্রাভেস্টি অব জাস্টিস, অর্থাৎ বিচারের নামে অবিচার। চতুর্থত, যেসব তথ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ছয় বছর আগে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগের তৎকালীন বেঞ্চ যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে আজহারুলের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়েছিল। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ওই বছরের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ১০ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। পরে পুনর্গঠন করা হয় আপিল বিভাগ। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আজহারুলের রিভিউ আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালে নিষ্পত্তি হওয়া আপিল পুনরায় শুনানির সিদ্ধান্ত দেন আপিল বিভাগ। সে অনুযায়ী আপিল শুনানি শেষে ৮ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার জন্য ২৭ মে দিন ধার্য করেন।

আজহারুল ন্যায়বিচার পেয়েছেন: আইনজীবী
রায়ের পর আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আজহারের আইনজীবী শিশির মনির। যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির ছয় শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, অন্ততপক্ষে পাঁচজন কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল। আজহারুল ইসলাম ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আমরা এটি মনে করি, এই রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান হয়েছে।

এ টি এম আজহার আজ বুধবার সকালে মুক্তি পাবেন বলে আশা করেছেন তাঁর আইনজীবী শিশির মনির। গতকাল বিকেলে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, আশা করি, আগামীকাল (আজ) সকালে এ টি এম আজহারুল ইসলাম পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি পাবেন।

কে এই আজহার
১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বাতাসন লোহানীপাড়া গ্রামে এ টি এম আজহারুল ইসলামের জন্ম। ১৯৬৮ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পরের বছর তিনি ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। একাত্তরে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, আজহার তখন জামায়াতের সেই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে তিনি দেশত্যাগ করেন এবং সৌদি আরবে চলে যান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আজহার আবার দেশে ফেরেন এবং ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন।

জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফেরার পর দলের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন আজহার। ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব পান এবং ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হন। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর কিছুদিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আজহার। 

যত অভিযোগ আজহারের বিরুদ্ধে
২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল এ টি এম আজহারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। যুদ্ধাপরাধের ছয় ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর তাঁর বিচার শুরু হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে আজহারুল ইসলাম ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি হিসেবে ‘আলবদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার’ ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে রংপুর অঞ্চলে ১ হাজার ২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শত শত বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ৯টি অভিযোগ করা হয়। এরপর ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ মামলায় রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

রায়ে মামলার দ্বিতীয় অভিযোগে রংপুরের বদরগঞ্জ থানার মোকসেদপুর গ্রামে গুলি চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা, তৃতীয় অভিযোগে বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিলের আশপাশের গ্রামে এক হাজার চারশর বেশি হিন্দু গ্রামবাসীকে গুলি চালিয়ে হত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে কারমাইকেল কলেজের চার অধ্যাপক ও এক অধ্যাপকের স্ত্রীকে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দুটি অভিযোগে কারাদণ্ড এবং একটি অভিযোগে খালাস দেওয়া হয়। এ মামলার প্রথম সাক্ষী ছিলেন একজন বীরাঙ্গনা, যাঁকে রংপুর টাউন হলে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

×