বিবিএসের জরিপ
রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারেন ২৭ শতাংশ নাগরিক

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫ | ০১:৫৭ | আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ | ০২:৪৭
দেশের ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তারা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারেন। ২১ দশমিক ৯৯ শতাংশ নাগরিক বিশ্বাস করেন, তারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব ফেলতে পারেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সিটিজেন পারসেপশন সার্ভের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
জরিপের তথ্য প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে এদিন সংবাদ সম্মেলন করে বিবিএস। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৬ নম্বর অভীষ্টের ছয়টি সূচক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে এ জরিপ পরিচালিত হয়। গত ৬ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই জরিপে দেশের ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানার ৮৪ হাজার ৮০৭ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ অংশ নেন।
ফলাফল প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে যারা মতামত প্রকাশ করতে পারেন বলে মনে করেন তাদের মধ্যে আছেন শহরের ২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ ও গ্রামের ২৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গ্রাম ও শহরে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য না থাকলেও লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য রয়েছে। পুরুষের ক্ষেত্রে ৩১ দশমিক ৮৬ শতাংশ মতামত দিতে পারলেও নারীর ক্ষেত্রে তা ২৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব ফেলতে পারেন বলে যারা মনে করেন (২১ দশমিক ৯৯ শতাংশ), তাদের মধ্যে নারী ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ পুরুষ ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও যা আছে
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত এক বছরে সরকারি সেবা গ্রহণ করেছেন এমন নাগরিকের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ সরকারি সেবা গ্রহণে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনকে ঘুষ দিতে হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় শীর্ষে আছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ প্রতিষ্ঠানে ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ নাগরিক ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এর পর রয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ৬১ দশমিক ৯৪, পাসপোর্ট অফিস ৫৭ দশমিক ৪৫ এবং ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।
জরিপে জানা গেছে, ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলাফেরা করতে নিরাপদ বোধ করেন। তবে রয়েছে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য। পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ৮৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ, নারীর ক্ষেত্রে ৮০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে নিরাপধ বোধ করেন ৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৮৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। নিজ বাসায় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি– ৯২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় আস্থার চিত্র
গত এক বছরে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন ৪৭ দশমিক ১২ শতাংশ নাগরিক। সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৭২ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবাকে সহজপ্রাপ্য এবং ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ সেবার ব্যয়কে সহনীয় মনে করেন। তবে স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে ৬৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণ ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং সময় দেওয়া নিয়ে ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
সরকারি শিক্ষায় ইতিবাচক প্রবণতা
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪০ দশমিক ৯৩ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছেন, তাদের অন্তত একটি সন্তান সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। প্রাথমিক স্তরে ৯৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ নাগরিক বিদ্যালয়ে সহজ প্রবেশাধিকার আছে বলে মনে করেন। ৯২ দশমিক ৬৬ শতাংশ নাগরিক ব্যয়কে সহনীয় বলে মনে করেন। মাধ্যমিক স্তরে এ হার কিছুটা কম– ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ ও ৮০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। শিক্ষার মান নিয়ে প্রাথমিক স্তরে ৬৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৭১ দশমিক ৮৬ শতাংশ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
অন্যান্য সরকারি সেবার মান
পরিচয়পত্র বা নাগরিক নিবন্ধনের মতো সেবায় ৭৮ দশমিক ১২ শতাংশ নাগরিক সেবার প্রাপ্যতা এবং ৮৬ দশমিক ২৮ শতাংশ ব্যয়কে গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তবে কার্যকারিতা ৬২ দশমিক ৬০ শতাংশ, সময়মতো সেবা ৫১ দশমিক ২৮ শতাংশ ও সমআচরণ ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ– এ তিনটি সূচকে সন্তুষ্টির হার তুলনামূলক কম।
বিচারপ্রাপ্তি ও বিরোধ নিষ্পত্তি
গত দুই বছরে ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো বিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আসতে পেরেছেন। এর মধ্যে ৪১ দশমিক ৩৪ শতাংশ আনুষ্ঠানিক (আদালত বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) এবং ৬৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক (এলাকার নেতা বা আইনজীবী) প্রক্রিয়ায় সেবা পেয়েছেন।
বৈষম্য ও হয়রানি
জরিপ অনুযায়ী, গত এক বছরে ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারীদের মধ্যে এই হার ১৯ দশমিক ৬২ এবং পুরুষদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে বৈষম্যের হার ২২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, যা গ্রামাঞ্চলের ১৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশের চেয়ে বেশি।
জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ঘুষ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল, সবাইকে ঘুষ দিতে হয়। তারপরও জরিপে উঠে এসেছে ৩১ শতাংশ নাগরিককে ঘুষ দিতে হয়। নারীদের কাছে তুলনামূলক ঘুষ কম চাওয়া হয়েছে। তুলনামূলক উচ্চবিত্তরা ঘুষ দেন বেশি। ঘুষ দিয়ে তারা মূলত সেবা কিনে নেন।’
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতির তথ্যে হতাশা ব্যক্ত করে উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা তো এখনও দাঁড়াতেই পারেনি, তারপরও তারা দ্বিতীয় অবস্থানে। এটি ভালো কথা নয়। আমার জানামতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুষ বাণিজ্য হয়। সেটি বেশির ভাগই বদলিকে কেন্দ্র করে। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী অনেক।’ পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতিও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
- বিষয় :
- বিবিএস