ঐকমত্যের সংলাপ
মৌলিক বিষয়ে দলগুলোর দূরত্ব কমেনি
বিএনপি-সমমনা দলগুলোর বিরুদ্ধে জামায়াত-এনসিপিসহ বাকিরা

প্রতীকী ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | ০১:৫২ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ | ০৭:৪১
সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে আয়োজিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো কয়েকটি বিষয়ে এখনও কাছাকাছি আসতে পারেনি। সংসদের উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন এর অন্যতম।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি এবং সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন নিয়েও দলগুলোর ঐকমত্য হয়নি গত সপ্তাহে হওয়া চার দিনের সংলাপে। দুই দিনের বিরতির পর আজ রোববার আবার শুরু হচ্ছে সপ্তাহব্যাপী সংলাপ। চলমান পর্ব ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ।
এ পর্যায়ে ঐকমত্যের সংজ্ঞা নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য প্রকাশ পেয়েছে। কমিশন এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার কথাও ভাবছে।
গত সপ্তাহের সংলাপের অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই বিষয়গুলোতে একদিকে বিএনপি এবং সমমনা পাঁচটি দল। তাদের কাছাকাছি অবস্থান বামপন্থি সিপিবি, বাসদের। বিএনপির বিপরীত অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বাকি দলগুলো। যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি, জেএসডির অবস্থানও বিএনপির বিপরীতে।
নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবের বিপক্ষে অনড় অবস্থান ধরে রেখেছে বিএনপি এবং সমমনা এলডিপি, এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট এবং ১১ দলীয় জোট।
চার দিনের সংলাপে ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোট শুধু ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিলে শর্ত সাপেক্ষে ঐকমত্য হয়েছে। যদিও জামায়াত বলেছে, শুধু অর্থবিল এবং আস্থা প্রস্তাব নয়, সংবিধান সংশোধনেও এমপিরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। বিএনপি বলেছে, যুদ্ধাবস্থায়ও দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না এমপিরা।
রাজনৈতিক দলগুলোর বড় মতপার্থক্য চলছে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন এবং এনসিসি গঠনে। এ দুই বিষয়কেই মৌলিক সংস্কার বলছে ঐকমত্য কমিশন। বিএনপি চায়, বিদ্যমান পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ আসন পাবে, ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষে তত আসন পাবে।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতিসহ ২৩ দল বলছে, নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে আসন বণ্টন হলে উচ্চকক্ষ কার্যকর থাকবে না। এ দলগুলো চায়, যে দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, উচ্চকক্ষে তত শতাংশ আসন পাবে।
কমিশনের সুপারিশ মেনে এই দলগুলো চায়, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সুষ্ঠু নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, ৫০ শতাংশ ভোটও পায়নি। উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ৬৫-৬৬ শতাংশ ভোট পেতে হবে, যা অসম্ভব। ফলে ভবিষ্যতে সরকারি এবং বিরোধী দলের ঐকমত্য ছাড়া সংবিধান সংশোধন সম্ভব না। বাংলাদেশে সরকারি এবং বিরোধী দলের ঐকমত্য আরও অসম্ভব। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় বিএনপি ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীতা দেখছে না।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সমকালকে বলেছেন, আমরা পুরো নির্বাচনই আনুপাতিক চাই। কিন্তু ঐকমত্যের স্বার্থে, শুধু উচ্চকক্ষ আনুপাতিক নির্বাচন হলেও ছাড় দিতে রাজি হয়েছি। ভোটের আনুপাতিক উচ্চকক্ষ না হলে আবার স্বৈরাচারের জন্ম হবে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এবং এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে সংসদের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ হলে তা রাজনৈতিক দলগুলোর ডাম্পিং গ্রাউন্ডে (ভাগাড়) পরিণত হবে।
২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, ৪০-৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েও কোনো দল সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ না হলে, বিজয়ী দল উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যখন, যেভাবে খুশি সংবিধান সংশোধন করতে পারেব।
সংলাপের সঙ্গে যুক্ত নাগরিক সমাজের একটি সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, উচ্চকক্ষের বিষয়ে বিএনপিকে রাজি করাতে মাঝামাঝি একটি অবস্থান নেওয়া হতে পারে। প্রস্তাব করা হতে পারে, নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধন করা যাবে। বিএনপির দিক থেকে এ বিষয়ে নমনীয়তার ইঙ্গিত আছে বলেও জানায় সূত্র।
সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, বিএনপি আগের অবস্থানেই রয়েছে। সংবিধান সংশোধন সহজ রাখার প্রস্তাব পাননি। প্রস্তাব পেলে বিএনপি রাজি কিনা– এমন প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আগে প্রস্তাব আসুক। বিএনপি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে অবস্থান জানাবে।’
আনুপাতিক উচ্চকক্ষে বিরোধিতার করে সালাহউদ্দিন বলেছেন, এতে সরকারি দল দেশ চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়বে। ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে উচ্চকক্ষে আইন পাস করাতে পারবে না। যেখানে অতীতে ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েও পূর্ণ মেয়াদে সরকার পরিচালনার নজির আছে।
ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্য সমকালকে বলেছেন, এ ভাষ্য ঠিক নয়। নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা সরকার দল উচ্চকক্ষে যত কম আসনই পাক, সরকার পরিচালনায় আইন প্রণয়নে বাধা নেই। নিম্নকক্ষের পাস করা বিল উচ্চকক্ষ শুধু একবার ফেরত পাঠাতে পারবে। নিম্নকক্ষ বিলটি আবার পাস করলে, আর উচ্চকক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থাতেও সংসদের পাস করা বিল একবার ফেরত পাঠাতে পারেন রাষ্ট্রপতি। দ্বিতীয়বার পাসের পর রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিতে বাধ্য থাকেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মানবাধিকার কমিশন এবং প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার রাশ টানতে কমিশন প্রস্তাব করেছে, এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে।
এতে সরকার দুর্বল হয়ে পড়বে দাবি করে বিএনপি এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করছে। দলটি সাংবিধানিক পদে নিয়োগের আইনগুলো শক্তিশালী করার প্রস্তাব করেছে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ২১টি দল এনসিসি গঠনের পক্ষে।
সূত্র জানিয়েছে, বিএনপিকে রাজি করাতে বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। কমিটি প্রস্তাব করেছে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং সরকারি ও বিরোধী দলের বাইরের একজন এমপিকে নিয়ে এনসিসি গঠিত হবে। বিএনপি এতে রাজি না হওয়ায় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে বাকিদের নিয়ে সাংবিধানিক নিয়োগ কমিশন গঠনের প্রস্তাব সামনে আসতে পারে। আজ শুরু হওয়া সংলাপে কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব আসার সম্ভাবনা আছে। এ কমিশন শুধু নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখবে। এনসিসির মতো শক্তিশালী হবে না।
এ বিষয়ে জামায়াত নেতা ডা. তাহের সমকালকে বলেন, ঐক্যের জন্য জামায়াত ছাড় দিতে প্রস্তুত। তবে আগে প্রস্তাব আসুক।
ঐকমত্যের সংজ্ঞা নিয়ে মতানৈক্য
শুধু বিএনপি রাজি না হওয়ায় অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না– এমন প্রবণতার অভিযোগ তুলে একাধিক দল বলছে, একটি বিষয়ে কত দল একমত হলে, তা ‘ঐকমত্য হয়েছে’ বলে গণ্য করা হবে– এ ব্যাপারে কমিশনের ব্যাখ্যা থাকা উচিত। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেছেন, শিগগির এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।
তবে কমিশন সূত্র জানাচ্ছে, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল যেসব বিষয়ে রাজি হবে, সেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। বড় দলগুলো একমত না হলেও তিন-চতুর্থাংশ দল একমত হলে ঐকমত্য হিসেব গণ্য করা হবে। যদিও বিএনপি এ সংজ্ঞায় রাজি নয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ঐকমত্য হতে হবে সর্বসম্মতিক্রমে।
- বিষয় :
- সংলাপ