বসনিয়ার জঙ্গলে ৩শ' বাংলাদেশি, মৃত্যু সঙ্গী করে ইউরোপ পাড়ির চেষ্টা

বসনিয়ার জঙ্গলে আটকে পড়া অভিবাসীরা- ছবি এএফপি
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ০৯:২৩ | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ১০:০৮
বসনিয়ার একেবারে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রান্তে কনকনে শীত পড়তে শুরু করেছে। আর ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার পথে এই অঞ্চলটির জঙ্গলে আটকা পড়েছেন শত শত অভিবাসী। তাদের মধ্যে প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশিও রয়েছেন।
পাহাড় বেয়ে অসংখ্য অভিবাসনপ্রত্যাশীর 'বলকান রুট' ধরে স্বপ্নের পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়ার একটি পথ হয়ে উঠেছে দরিদ্র দেশ বসনিয়া। তবে অনেকেরই শেষ পর্যন্ত স্বপ্নের দেশে আর যাওয়া হয় না। মৃত্যুতে ইতি ঘটে অনিশ্চিত যাত্রার। খবর এএফপির
প্রতিদিন অবৈধভাবে ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন বহু লোক। বসনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত একটি জংলি পাহাড় বেয়ে যেতে হয় অভিবাসীদের। অনেকে আবার ইতোপূর্বে এই পাহাড় সফলভাবে পাড়ি দেওয়া অভিবাসীদের পাঠানো জিপিএস ব্যবহার করেন। তবে ক্রোয়েশিয়ার পুলিশ তাদের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। ধরতে পারলেই তাদের আবার বসনিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয়দের চাপের কারণে বসনিয়া কর্তৃপক্ষ সেখানকার আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরের ছোট শহর ভেলিকা ক্লাদুসা-সংলগ্ন জঙ্গল থেকে চতুর্থবারের মতো ওই পাহাড়টি পাড়ি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলাদেশি মাহবুবুর রহমান। ২৩ বছরের এই তরুণ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ছাড়েন। আসন্ন শীতের আগেই তিনি ইতালিতে পৌঁছতে বদ্ধপরিকর।

একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস করছেন মাহবুব এবং আরও ৩০০ বাংলাদেশি। তাদের বেশিরভাগই তরুণ। প্লাস্টিকের তারপলিনের নিচে ঘুমাচ্ছেন তারা। এতে রাতের শীত থেকে সুরক্ষা মেলে না। এখানে শিগগিরই তাপমাত্রা নামবে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে।
মাহবুব এএফপিকে বলেন, 'এখন ভীষণ শীত। বৃষ্টিও হচ্ছে। আমাদের খাবার নেই, পানি নেই। লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।' দিনের বেলায় তাদের অনেকে আশপাশে গোসল সেরে নেন। অন্যরা আবার সামান্য ভাত রান্না করেন কিংবা পাস্তা বানান। মাহবুব বলেন, ক্রোয়েশিয়ার পুলিশ যেভাবে ঠেলে ফেরত পাঠায় তাও এক ধরনের নির্যাতন। তারা আমাদের জ্যাকেট, ব্যাগ, খাবার, জুতা, অর্থকড়িসহ সবকিছু কেড়ে নেয়।

এই অভিবাসীরা এসেছেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান অথবা মরক্কো থেকে। তারা অভিযোগ করেন, ক্রোয়েশিয়ার পুলিশ তাদের মারধর করে থাকে। তবে দেশটির কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের মধ্যে প্রায়ই মারামারির মতো ঘটনাও ঘটে। গত বুধবার আফগান অভিবাসীদের সঙ্গে বাদানুবাদের জেরে দুই পাকিস্তানি নিহত এবং প্রায় ২০ জন আহত হন বলে জানায় পুলিশ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাব অনুসারে দেশটিতে প্রায় আড়াই হাজার অভিবাসী খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নিয়েছেন। তবে সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ায় এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

আইওএমের বসনিয়ার প্রতিনিধি পেটার ভন ডার আওয়েরায়ার্ট সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'আমরা দ্রুত একটি মানবিক সংকটের দিকে এগোচ্ছি। নভেম্বরের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া অভিবাসীর সংখ্যা চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার হতে পারে। এই অঞ্চলটিতে প্রচুর বরফ ও ঠান্ডা পড়ে।'
বুধবার বসনিয়া কর্তৃপক্ষ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিহাকে আইওএম পরিচালিত একটি আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। সেখানে দুই হাজার লোক ছিল। এক মাস আগে এই কেন্দ্রে নতুন কেউ ঢুকতে পারেনি। আবার কেউ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রটি ছাড়লে পুনরায় তার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

স্থানীয় কর্মকর্তা মুস্তফা রুজনিক বলেন, কেন্দ্রটি নিরাপত্তা ও পয়ঃনিস্কাশনের জন্য সংকট তৈরি করেছিল। ভেলিকা ক্লাদুসায় আরও একটি কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে চায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে আছে ৭০০ লোক। এখানে নতুন করে কোনো অভিবাসীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয়রা এসব কেন্দ্র বন্ধ করার দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেছে। নভেম্বরের স্থানীয় নির্বাচনের আগে বিষয়টি স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে যাওয়া ৪৮ বছর বয়সী কফিল কশর গত দেড় বছরে ১৪ বার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ক্রোয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আবার সুযোগ খুঁজছেন তিনি। কফিল বলেন, 'আমরা এখানে বাঁচার জন্য এসেছি। অথচ আমাদের লাথি খেতে হচ্ছে, মারধর করা হচ্ছে। পরেরবার তারা হয়তো আমাদের মেরেও ফেলতে পারে। আমরা হতাশ।'
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সমকালকে বলেন, অবৈধ ও বিপদসংকুল পথে ইউরোপ যাওয়ার এ চেষ্টা খুবই দুঃখজনক। এর ফলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, বৈধভাবে অভিবাসী হওয়ার পথও সংকুচিত হয়। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে এক ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে বৈধ পথে অভিবাসী হওয়ার পথ সংকুচিত করার জন্য। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে, অবাস্তব স্বপ্ন দেখিয়ে এভাবে লুকিয়ে ইউরোপ নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

মন্ত্রী বলেন, অবৈধ পথে এখন ইউরোপে যাওয়া এবং অভিবাসী হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। এই মহামারির সময়ে দেশে দেশে প্রবেশের সুযোগও একেবারেই সীমিত। এটা জেনেও যারা ফুসলিয়ে, লুকিয়ে ইউরোপ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তারা ষড়যন্ত্রকারী হিসেবেই বিবেচিত হয়। এই ষড়যন্ত্রকারীরা এখন কথায় কথায় 'অভিবাসন এবং মানব পাচার' এক শব্দ হিসেবে উচ্চারণ করে। অথচ অভিবাসন বৈধ এবং পাচার অবৈধ। দুটোকে কোনোভাবেই একসঙ্গে উচ্চারণ করা যায় না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ চায় আরও বেশি নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিত করতে। একই সঙ্গে মানব পাচারের বিরুদ্ধে সরকারে অবস্থানও কঠোর। অযথা লাখ লাখ টাকা খরচ করে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়।
- বিষয় :
- বসনিয়া
- জঙ্গলে আটকা
- অভিবাসী