ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু

ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু

রোহিঙ্গাদের পরিবহনকারী বাসগুলো বৃহস্পতিবার কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে টেকনাফ থেকে যাত্রা শুরু করে - সংগৃহীত

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা; কক্সবাজার অফিস ও টেকনাফ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০ | ২২:১৬

মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হয়েছে। স্বেচ্ছায় যেতে আগ্রহীদের প্রথম দল গতকাল বৃহস্পতিবার ভাসানচরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। এতকাল ধরে তারা অবস্থান করছিলেন কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে।

সূত্রমতে, গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত অন্তত দেড় হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফের ক্যাম্প থেকে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা হন। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সাময়িকভাবে বসবাসের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়ায় ভাসানচরে তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশে দৃষ্টিনন্দন আবাসন ব্যবস্থা। শহরের অধিকাংশ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে কুতুপালংসহ আরও কিছু ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের গাড়িতে করে নিয়ে প্রথমে চট্টগ্রামে আনা হয়। পতেঙ্গায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর রেডি রেসপন্স বাথ, বিএফ শাহীন কলেজ, বোট ক্লাব এলাকায় অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। পাশেই জেটিতে অপেক্ষা করছে বেশ কয়েকটি জাহাজ। আজ শুক্রবার জলপথে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পৌঁছে দেওয়া হবে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সমকালকে জানান, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে র‌্যাব শুধু আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি দেখভাল করছে। সার্বিক নিরাপত্তায় র‌্যাবের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চরম নজিরবিহীন নৃশংসতার শিকার হয়ে বিভিন্ন সময় দেশটি থেকে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসে। মাঝে দুই দফায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলেও তাদের পাঠানোর প্রক্রিয়া সফল হয়নি। মূলত মিয়ানমার কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। ফলে বহুদিন ধরেই কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে তারা বসবাস করে আসছেন। সেখানে চাপ কমানোর জন্য আপাতত সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, শুরুতে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি করা হয়। গতকাল যখন অনেক পরিবার ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা হন, তখন আরও কিছু পরিবারও তাৎক্ষণিকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করে। আগে তারা ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন। প্রথম ধাপে রোহিঙ্গারা সেখানে গিয়ে যখন দেখবে বসবাসের পরিবেশ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কক্সবাজারের তুলনায় অনেক ভালো, তখন আরও অনেকেই সেখানে যেতে চাইবে।

ভাসানচরে এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি ক্লাস্টার হাউস ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন। গুচ্ছ গ্রামের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে এসব ক্লাস্টার হাউস। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে ১২টি গৃহ। প্রতি গৃহে রয়েছে ১৬টি রুম। একেক রুমে চারজন থাকার ব্যবস্থা। রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের তুলনায় ভাসানচরে অনেক ভালো প্রাকৃতিক নান্দনিক পরিবেশে বসবাস করতে পারবেন বলে নিরাপত্তাকর্মীরা জানান।

গতকাল সকাল ১১টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়া কলেজ মাঠ থেকে 'চল চল ভাসানচর চল' লেখা ব্যানার লাগিয়ে রোহিঙ্গা-বহরের ৩৮টি বাস চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করে। বিকেল ৫টা পর্যন্ত বাস ছেড়ে যায়। তবে এই বাসে করে গতকাল কত রোহিঙ্গা গেছে, তা সরকারি কোনো কর্মকর্তা জানাতে রাজি হননি। যদিও একাধিক সূত্র জানায়, এসব বাসে অন্তত এক হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা ছিলেন।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রথমে উখিয়া ট্রানজিট পয়েন্ট ও কলেজ মাঠে অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়। সকালে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে বাসে তোলা হয়। এরপর সড়কপথে রোহিঙ্গাদের নেওয়া হয় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা। সেখান থেকে শুক্রবার সকালে জাহাজে করে ভাসানচরে নেওয়া হবে।

মাঠ পর্যায়ে থাকা সরকারি একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের বুধবার রাত থেকে নিজ নিজ ক্যাম্প থেকে উখিয়ার দুটি অস্থায়ী ক্যাম্পে এনে রাখা হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উখিয়া কলেজ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের বহন করতে আসা অর্ধশত বাসের দীর্ঘ লাইন। সেখানে তাদের মালপত্র বহন করতে নিয়ে আসা হয়েছে বেশ কয়েকটি ট্রাকও। সব মিলিয়ে ৯০টি গাড়ি ছিল। এ সময় তাদের সঙ্গে শেষ দেখা করতে স্বজনরা ভিড় করেন সেখানে।

ওমর হামজা নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, 'আশা করছি এখান থেকে ভাসানচরে গিয়ে পরিবার নিয়ে সুখে থাকব। বাকিটা সেখানে যাওয়ার পর বলতে পারব।' এ সময় তার পাশে ছিলেন তার বৃদ্ধ মা রহিমা খাতুন।

স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাসানচরে যেতে উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট পয়েন্টে এসেছেন মো. তৈয়ুব নামে আরেক রোহিঙ্গা। তিনি কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা। তিনি বলেন, 'এখানে কষ্টে আছি, তাই স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাওয়ার তালিকায় নাম দিয়েছি। সেখানে যাওয়ার জন্য ক্যাম্পে এসেছি।'

সমুদ্রে মাছ ধরে সংসার চালাতেন টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা সালামত উল্লাহ। বৃহস্পতিবার সকালে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, 'মালপত্রসহ ঘরটি আট হাজার টাকায় পাশের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। শুনেছি ভাসানচরে আমাদের জন্য পাকা বাড়ি করা হয়েছে। তাই স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সেখানে চলে যাচ্ছি।'

টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের নাহার বেগম নামে এক বৃদ্ধ নারী বলেন, 'কেউ জোর জবরদস্তি করেনি, স্বেচ্ছায় আমরা ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছি। পরিবারের ১১ জন সদস্য আছে। সবাই সেখানে চলে যেতে একমত হয়েছি।

বালুখালী ক্যাম্প-২০-এর হেড মাঝি মোহাম্মদ হোছন বলেন, ক্যাম্প-২০ এবং ২০ এক্সটেনশন থেকে আটটি রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। ক্যাম্প-১৭-এর মাঝি মোহাম্মদ নুর বলেন, তার ক্যাম্প থেকে ৭০ পরিবার ভাসানচরে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছে। ক্যাম্প-৫-এর হেড মাঝি জাফর আলম বলেন, এ ক্যাম্প থেকে পাঁচটি রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে রওনা হয়েছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা ও খাদ্যসামগ্রী মজুদ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার আগে প্রস্তুতি দেখতে ২২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধি সোমবার ভাসানচর পরিদর্শন করেন। তারা সরকারের পরিকল্পিত আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন এনজিও প্রতিনিধিরা। সেখানে উন্নতমানের একটি আবাসিক এলাকায় যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তার সবই রয়েছে বলে তারা জানান।

সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার (স্কাস) চেয়ারপারসন জেসমিন প্রেমা বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিরাপদ জীবনের কথা চিন্তা করে এক লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এটা ভালো উদ্যোগ। তুলনামূলক অনেক বেশি সুন্দর ও নিরাপদ আবাসন ভাসানচর।

বেসরকারি সংস্থা মুক্তির কর্মকর্তা ফয়সাল বারী বলেন, বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারে ভূমিধস হয়। সেখানে রোহিঙ্গারা বন উজাড় করছে। ভাসানচরে তাদের থাকা অনেক নিরাপদ হবে।

টেকনাফ শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা (সিআইসি) নওশের ইবনে হালিম বলেন, 'বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত তার ক্যাম্প থেকে ২৪টি রোহিঙ্গা পরিবারকে উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হয়।'

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এক কর্মকর্তা জানান, ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটি শুক্রবার সকালে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জাহাজে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। এই দলে আড়াই হাজার রোহিঙ্গার ভাসানচরে যাওয়ার কথা।

বদলে গেছে ভাসানচর :সব মিলিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য শতভাগ প্রস্তুত প্রায় ১৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার ভাসানচর। আধুনিক বর্জ্য ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা, বায়োগ্যাস প্লান্ট ও সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে।

রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অস্থায়ীভাবে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে 'আশ্রয়ণ-৩' নামে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। চরটি বসবাসের উপযোগী করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন ও দ্বীপটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই প্রকল্পটির প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এরপর ভাসানচর ঘিরে আবাসন নির্মাণের লক্ষ্যে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে সম্ভাব্যতা নিরীক্ষা করে প্রণয়ন করা হয় ডিপিপি। প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা। বাঁধ ও জেটি নির্মাণের জন্য পরে প্রকল্প ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। বর্তমানে ভাসানচরে ৩০৬ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৯৭, নারী ১৭৬ ও শিশু ৩৩ জন। চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের জলসীমা থেকে আটকের পর তাদের ভাসানচরে নির্মিত ক্লাস্টারে নিয়ে রাখা হয়।

আরও পড়ুন

×