হাজী সেলিমপুত্র ইরফান দুই মামলায় দায়মুক্ত

ইরফান সেলিম
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২১ | ১৫:১৮
ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে দুটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ। ইরফানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকবিরোধী আইনে লালবাগ থানায় ওই মামলা করেছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। মামলার এজাহারে বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য ভিন্ন হওয়ায় এবং অভিযোগের পক্ষে 'তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায়' গতকাল রোববার আদালতে ওই রিপোর্ট দেওয়া হয়। পুলিশের এই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, 'ফাইনাল রিপোর্ট অ্যাজ মিসটেক অব ফ্যাক্ট (এফআরএমএফ)'। মামলার দুই মাসের মাথায় এ প্রতিবেদন দেওয়া হলো। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র গতকাল সমকালকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
দুই মামলার অভিযোগের দায় থেকে 'মুক্তি' পাওয়ার পর এখন ইরফানের বিরুদ্ধে আর একটি মামলা তদন্তাধীন। নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তার করা এ মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ইরফানের বিরুদ্ধে দুটি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, 'মিসটেক অব ফ্যাক্ট'।
ইরফানের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'ইরফানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকের মামলার তদন্ত করেছে লালবাগ থানা পুলিশ। আমরা তদন্ত করে যা পেয়েছি, তা রিপোর্টে উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছি। প্রতিবেদনটি এখন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে।'
ইরফানের মামলার এ প্রতিবেদনের ব্যাপারে বিস্তারিত আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তদন্ত কর্মকর্তা।
গত ২৫ অক্টোবর রাতে ধানমন্ডিতে হাজী মোহাম্মদ সেলিমের 'সংসদ সদস্য' লেখা সরকারি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়। পরদিন এ ঘটনায় ইরফানসহ আরও চারজনের নাম উল্লেখ ছাড়াও অজ্ঞাতপরিচয় দু-তিনজনকে আসামি করে ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। ২৬ অক্টোবর পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের বাসায় দিনভর অভিযান চালায় র্যাব। ইরফানকে দেড় বছর ও তার দেহরক্ষীকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ মামলায় এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত চার আসামির সবাইকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ইরফান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের সাসপেন্ড হওয়া কাউন্সিলর। তার শ্বশুর নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী।
এ ঘটনার পর হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি ইরফানের অবৈধ সম্পদেরও অনুসন্ধান করে। ওই ঘটনার পর সরকারের অন্য একটি সংস্থা হাজী সেলিমের অবৈধ দখলে থাকা জায়গা উদ্ধারে অভিযান চালায়। ভেঙে দেওয়া হয় তার দখলে থাকা বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা। এ ঘটনার পর থেকে ইরফানের ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার (ভিপিএস) ব্যবহার, ৪০ জনের বেশি দেহরক্ষী নিয়ে চলা, টর্চার সেল, বাবার মতো অবৈধ জমির কারবারসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার দাপটের বিষয়গুলো সামনে আসতে থাকে। তবে পুলিশের রিমান্ডে অনেক অভিযোগ অস্বীকার করেন ইরাফান।
পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের বাসায় অভিযানের পর মাদক, অস্ত্র, ওয়াকিটকিসহ গ্রেপ্তার ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে র্যাব। এ ছাড়া তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। র্যাব বাদী হয়ে মামলাগুলো করে চকবাজার থানায়। এর মধ্যে ইরফানের বিরুদ্ধে করা দুটি মামলার তদন্ত শেষ করেছে লালবাগ থানা পুলিশ। এ ছাড়া নৌবাহিনীর কর্মকর্তা বাদী হয়ে ইরফান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছেন, সেটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
জানা গেছে, কোনো মামলার এজাহারে বর্ণিত ঘটনা তদন্তে সঠিক প্রমাণিত না হলে এবং অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলেও কোনো সাক্ষী-প্রমাণ পাওয়া না গেলে সে ক্ষেত্রে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা পিআরবি-২৭৫ বিধি এবং বিপি ফরম নং-৪২ অনুসারে আদালতে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য যে রিপোর্ট পেশ করেন, তাকে চূড়ান্ত রিপোর্ট বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের চূড়ান্ত রিপোর্টের মধ্যে রয়েছে- চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য, চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিথ্যা, চূড়ান্ত প্রতিবেদন তথ্যগত ভুল, চূড়ান্ত প্রতিবেদন আইনগত ভুল ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন আমলের অযোগ্য। চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য হলো- এজাহারের বর্ণিত তথ্য সত্য, কিন্তু কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই; চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিথ্যা হলো- ঘটনা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক; চূড়ান্ত প্রতিবেদন তথ্যগত ভুল হলো- তদন্তে প্রাপ্ত ঘটনা এক রকম এবং এজাহারে বর্ণিত ঘটনা অন্য প্রকার; চূড়ান্ত প্রতিবেদন আইনগত ভুল হলো- যে আইনে এজাহার করা হয়েছে, সে আইনে নয়, মামলা চলবে অন্য আইনে; চূড়ান্ত প্রতিবেদন আমলের অযোগ্য হলো- এজাহারে বর্ণিত ঘটনা আংশিক প্রমাণিত হলে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে কোনো আমলযোগ্য অপরাধের মামলার সব আসামিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়ে থাকে। তদন্তে সন্তুষ্ট না হলে বাদীপক্ষ আদালতে নারাজি দিতে পারে। ইরফানের ঘটনায়ও পুনঃতদন্ত চেয়ে আবেদন করতে পারবে বাদীপক্ষ।
চকবাজার থানায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল- ঘটনার দিন সকালে বিশেষ অভিযান পরিচালনার সময় মামলার বাদী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তিনি জানতে পারেন, চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনের ২৬ নম্বর বাসা 'চান সর্দার দাদাবাড়ি'তে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসসহ কয়েকজন অবস্থান করছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ফোর্সসহ ওই সময়ই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে রওনা দেন তিনি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দু'জন দৌড়ে ভবনের ওপরের দিকে উঠে যায়। ভবনটি ঘেরাও করে ফেলেন তারা। পরে চার সাক্ষীর উপস্থিতিতে র্যাব তল্লাশি চালায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করেছিল, নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের পর বাসায় ফেরেন ইরফান। তারপর আঁচ করতে পারেন বড় ধরনের 'বিপদ' আসন্ন। সারারাত মদ পান করেন তিনি। অভিযান চলার সময় তার ডোপ টেস্ট করানো হয়। সেখানে তার রেজাল্ট 'পজিটিভ' আসে।
অভিযানের পর র্যাব জানায়, হাজী সেলিমের বাসা থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৭টি ওয়াকিটকি, ১০ ক্যান বিয়ার, একটি হাতকড়া, একটি ড্রোন, ৪০৬ পিস ইয়াবা এবং বিদেশি মদ ও বিয়ার পাওয়া গেছে। এই বাসা থেকে তিনটি অস্ত্রও জব্দ করা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি একনলা বন্দুকের লাইসেন্স ছিল। অন্য দুটি পিস্তলের লাইসেন্স নেই বলে জানানো হয়। আর ওয়াকিটকিগুলোও ছিল অবৈধ।
আরেক মামলার তদন্ত: নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধরের মামলায় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম, প্রটোকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু, দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদ ও গাড়িচালক মিজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও তিন-চারজনকে আসামি করা হয়েছিল। এজাহারে বেআইনিভাবে পথরোধ করে সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর, জখম ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। পরে থানা থেকে মামলার তদন্তভার ডিবির ওপর ন্যস্ত হয়।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা গতকাল জানান, নৌবাহিনীর কর্মকর্তার করা মামলার তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। এখন পর্যন্ত এ মামলায় যে তথ্য-উপাত্ত মিলেছে, তাতে ইরফান ও তার সহযোগীদের অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব। দ্রুত সবার অপরাধের আরও চুলচেরা বিশ্নেষণ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
- বিষয় :
- মামলা
- হাজী সেলিম
- ইরফান
- সেলিমপুত্র ইরফান