ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ধর্ষণের শিকারদের প্রায় অর্ধেকই শিশু-কিশোরী

ধর্ষণের শিকারদের প্রায় অর্ধেকই শিশু-কিশোরী

আতাউর রহমান

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২১ | ০৯:১৫

টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের সাতকুয়া পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিল স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির চার শিক্ষার্থী। দিনে-দুপুরেই একদল দুর্বৃত্ত গভীর বনে নিয়ে তাদের তিনজনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। অপর কিশোরীও শ্নীলতাহানির শিকার হয়। গত বছরের ২৬ জানুয়ারি ন্যক্কারজনক ওই ঘটনা ঘটে। এর পর এক বছর হয়ে গেলেও পুলিশ মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি।

গত ১৩ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানের নর্থ সার্কুলার রোডের ৫৮ নম্বর বাসার ছাদে ভেজা কাপড় শুকাতে গিয়েছিল ১৩ বছরের কিশোরী জান্নাত। সেখানে নিরাপত্তাকর্মী জুনায়েদ তাকে ধর্ষণ করে। ঘটনাটি লোকজন জেনে ফেলায় লজ্জায় বাসার বাথরুমে ঢুকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সেই কিশোরী।

টাঙ্গাইল বা ঢাকার কলাবাগানের ওই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ২০২০ সালে দেশে সংঘটিত ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাগুলো বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, শিশু-কিশোরীরাই ভয়ংকর ওই অপরাধের শিকার হচ্ছে বেশি। ওই বছরের ৯ অক্টোবর একদিনেই গণমাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ১৯টি ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়, যাদের মধ্যে ১৪ জনই শিশু-কিশোরী।

জাতীয় মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সারাদেশে এক হাজার ৩৪৬ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। অন্যদিকে 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' বলছে, ওই বছর ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সে হিসাবে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের শিকারদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫০ ভাগই শিশু।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রকাশিত তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, গত বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩১৭ জন নারী ও শিশু। তাদের মধ্যে ১৭৬ জনের বয়স নির্ণয় করা যায়নি। বয়স নিরূপণ হওয়া ১৪১ জনের মধ্যে ৮৫ জনই শিশু। অর্থাৎ ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের মধ্যে ৬০ দশমিক ২৮ ভাগই শিশু। ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ৬৪ দশমিক ২৯ ভাগ এবং ৭০ ভাগ শিশু-কিশোরী ধর্ষণের পর লজ্জায় আত্মহত্যা করে।

দেশে নারী ও শিশু সুরক্ষায় আলাদা আইন রয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা-সংগঠনও নারী-শিশুর সুরক্ষা নিয়ে সোচ্চার। তবে শিশু-কিশোরীদের ওপর ভয়ংকর ওই অপরাধ চলছেই।

নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু ও কিশোরীরা সহজেই ভিকটিম হয়। বয়স কম হওয়ায় এবং আগেভাগে জানাশোনা না থাকায় পরিস্থিতি মোকাবিলার মতো অভিজ্ঞতাও থাকে না তাদের। কীভাবে নিজেকে সুরক্ষা করতে হবে তাও জানে না তারা। ওই সুযোগই নেয় অপরাধীরা। তা ছাড়া আত্মীয় বা প্রতিবেশীর মাধ্যমেও শিশু-কিশোরীদের বড় একটা অংশ ঘটনার শিকার হচ্ছে।

'ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট'-এর চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ সমকালকে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তরা শিশুকে চকলেট বা খাবারের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করে থাকে। খালি বাসায়ও তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। গ্রুপ স্টাডি বা কোচিং ও শ্রেণিকক্ষেও শিশু-কিশোরীর ধর্ষণ বা শ্নীলতাহানির খবর আসে। তাই এসব ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তাদের পরিস্থিতি মোকাবিলার মতো শিক্ষা দিতে হবে। শিশু- কিশোরীরা একা থাকলে বা একা কোথাও গেলে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে- তা পাঠ্যক্রমে থাকা উচিত। পাশাপাশি এসব ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশলও তাদের জানাতে হবে। শ্রেণিকক্ষ ও পরিবার থেকে এই শিক্ষা দিতে হবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, অপরাধীরা বিবেচনা করে কোন অপরাধ করলে তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না। শিশুদের প্রতিবাদ করা বা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা না থাকায় অপরাধীরা তাদের টার্গেট করে থাকে। এ ছাড়া দেশে ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে বড় একটা অংশ দরিদ্র শ্রেণির। ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধের ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক বিষয়টিও কাজ করে। এসব কারণে শিশু ধর্ষণের শিকারের হার বেড়েই চলেছে।

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) আফরোজা ফারহানা অরেঞ্জ সমকালকে বলেন, অন্যান্য মামলার মতো শিশু ধর্ষণের মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়াও নানা কারণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এতে সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না এবং আলামতও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সব মামলায় শাস্তিও নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এতে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

×