'পরিচয় দিয়েছেন, আশ্রয়ও দিলেন শেখ হাসিনা'

প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ঘর পেয়েছেন কুড়িগ্রামের গৃহহীন দেলু বেগম (বাঁয়ে) ও আলীফ উদ্দিন - সমকাল
অমরেশ রায়, কুড়িগ্রাম থেকে
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২১ | ২০:৫০
'ওপরে আল্লাহর রহম, নিচে শেখ হাসিনার দয়া। তাই নতুন বাংলাদেশে (সাবেক দাসিয়ারছড়া) ভালো আছি। শেখ হাসিনাই পরিচয় দিয়েছেন, আশ্রয়ও দিলেন।' বলছিলেন ৬২ বছরের আলীফ উদ্দিন। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার সাবেক ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার মানুষ তিনি। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ের সময় দাসিয়ারছড়ায় থেকে গিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ভারতের নয়- বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই মাটিতে আমৃত্যু থেকে যেতে যান। এভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বদৌলতে নাগরিক পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি।
এ ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর আলীফ উদ্দিন আপন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ফলে। ফুলবাড়ী ইউনিয়নের কামালপুরে (সাবেক দাসিয়ারছড়া) আরও ১৩ জন ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের পাশাপাশি আলীফ উদ্দিনকেও সুদৃশ্য গৃহ উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
শুধু আলীফ উদ্দিনই নন, ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবার আজ শনিবার পাচ্ছে তাদের স্থায়ী ঠিকানা। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন ৯ লাখ পরিবারের মধ্যে প্রথম ধাপের এই পরিবারগুলোকে জমি ও ঘর তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জমি ও ঘর হস্তান্তর কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে ৭৪৩টি ব্যারাকে তিন হাজার ৭১৫ পরিবারকে পুনর্বাসনও করা হবে। অর্থাৎ, এই ধাপে মোট ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারকে ঘর দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে একক গৃহ এবং ব্যারাকে মোট ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর দেওয়ার ঘটনা বিশ্বে এটিই প্রথম। বিশ্বের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ আশ্রায়ণ প্রকল্পের উদ্বোধনের মাধ্যমে আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
সাবেক দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে স্থাপিত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের নতুন নিবাসে সপরিবারে ঠাঁই মিলেছে আলীফ উদ্দিন ছাড়াও আবদুস সালাম (৬৫), আক্তার আলী (৫২) এবং স্বামী পরিত্যক্ত মুক্তা বেগমের (২৫)। এ চারজনই জন্মভিটা বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চাননি। শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে সুদৃশ্য গৃহ পেয়ে তারা খুবই উচ্ছ্বসিত। অভিন্ন ভাষায় তারা বললেন, নতুন বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে শেখ হাসিনার জন্য শতকোটি দোয়া করছেন তারা।
এই কুড়িগ্রাম জেলারই সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের খাটামারি গ্রামের ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর জন্য নির্মিত নিবাসে ঠাঁই পেয়েছেন ৯০ বছরের দেলু বেগম। এতদিন তাকে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাঙা ঘরে আশ্রয় নিয়ে থাকতে হতো। তিনি বললেন, 'যিনি তাদের ঘর করে দিয়েছেন, সেই শেখ হাসিনার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করব। আল্লাহ খুশি, শেখ হাসিনা খুশি, আমরাও খুশি।' একই নিবাসের সমস্তভান বেগম (৫৮) জানান, তারও কোনো ঘরদুয়ার ছিল না। ২৮ বছর ধরে তাকে এর-ওর বাড়ি থাকতে হতো। শেখ হাসিনা তাকে ঘর দিয়েছেন, স্থায়ী ঠিকানা দিয়েছেন।
একই জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের চর বেরুবাড়ী গ্রামে ঘর পেয়েছেন ৭০ বছর বয়সী বিধবা লালবানু। তিনি বলেন, 'মানুষের সাহায্য নিয়ে চলতাম, মানুষের বাড়ি থাকতাম। আল্লাহর রহমতে এবার শেখ হাসিনা ঘর দিছে।'
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম জানান, 'মুজিববর্ষ' উপলক্ষে 'আশ্রয়ণের অধিকার- শেখ হাসিনার উপহার' এই স্লোগানকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় এসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলায় মোট এক হাজার ৫৪৯টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার প্রথম ধাপে দুই শতাংশ জমিসহ ঘর পাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগের আওতায় আসবেন।
গৃহহীন ও ভূমিহীনদের স্থায়ী ঠিকানা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প প্রথম পর্যায়ের ৬৬ হাজার ১৮৯টি একক গৃহ নির্মাণের সামগ্রিক কার্যক্রম সমন্বয় করছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে একক গৃহগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় তালিকাভুক্ত পরিবারগুলো গৃহের পাশাপাশি দুই শতাংশ খাসজমিও বরাদ্দ পেয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত সব গৃহের নকশা একই রকম। প্রতিটি গৃহে ইটের দেয়াল, কংক্রিটের মেঝে এবং লাল, নীল ও সবুজ রঙের টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি দুটি করে শোয়ার ঘর, একটি রান্নাঘর, টয়লেট এবং সামনে খোলা বারান্দা থাকবে। গৃহপ্রতি এক লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ হিসাবে গৃহহীনদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এক হাজার ১৬৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।
গত বছরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুজিববর্ষে দেশে কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না। সরকার সব ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে ঘর তৈরি করে দেবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে শুরু হয় সারাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে গৃহহীন-ভূমিহীনদের তালিকা তৈরি করে বাড়ি নির্মাণের মহাযজ্ঞ। চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘোষিত মুজিববর্ষের মধ্যেই এসব ঘর নির্মাণকাজ শেষ করতে চায় সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মাহবুব হোসেন বলেন, প্রথম ধাপে আজ শনিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবারকে একক গৃহ হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বরাদ্দ করা হবে আরও এক লাখ একক ঘর। এজন্য দুটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। একটি তালিকা করা হয়েছে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের। এর সংখ্যা দুই লাখ ৯৩ হাজার ৬১টি পরিবার। আর দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছেন, যাদের জমি আছে কিন্তু ঘর নেই অথবা জরাজীর্ণ ঘর রয়েছে, তালিকাভুক্ত এমন পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি পরিবার।
সরকারের হিসাবমতে, সারাদেশে আট লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে এক লাখ ২৯ হাজার ১৯৭, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬ হাজার ৩, চট্টগ্রাম বিভাগে এক লাখ ৬১ হাজার ২৯৭, রংপুর বিভাগে এক লাখ ৮৩ হাজার ৮৩৪, রাজশাহী বিভাগে ৯৬ হাজার ৫০৪, খুলনা বিভাগে এক লাখ ৪২ হাজার ৪১১, বরিশাল বিভাগে ৮০ হাজার ৫৮৪ এবং সিলেট বিভাগে ৫৫ হাজার ৬২২টি গৃহহীন পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে জমি ও ঘর নেই এমন পরিবারের পাশাপাশি ১০ শতাংশ জমি আছে, অথচ ঘরবাড়ি জরাজীর্ণ, এমন পরিবারও রয়েছে। মুজিববর্ষে এই প্রায় ৯ লাখ পরিবারই পর্যায়ক্রমে গৃহ পাচ্ছে। যার সূচনা ঘটছে আজ প্রথম ধাপের ৬৯ হাজার ৯০৪টি গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে।