বিদেশে চিকিৎসা নিতে নিতেই দেশে জাহাজ পরিদর্শন!

অমরেশ রায়
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১৬:৪৬
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অঙ্গ সংস্থা নৌবাণিজ্য দপ্তরে তুঘলকি কাণ্ড চলছে। অপেশাদার ও সার্ভেয়ার না হওয়ার পরও কর্মকর্তারা নতুন জাহাজ রেজিস্ট্রেশনের ডকিং সুপারভিশন দেখাচ্ছেন। এর ফি বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছেন। এমনকি বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়েও কাগজে-কলমে দেশে জাহাজ পরিদর্শন দেখিয়ে ফি আদায় করছেন কেউ কেউ।
এই সুপারভিশন ফি এবং ওভারটাইম (ওটি) বিল নিয়ে আবার দুই কর্মকর্তার মধ্যে রশি টানাটানির বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটেছে। গঠন করতে হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি।
চট্টগ্রামের নৌবাণিজ্য দপ্তরের সাবেক ও বর্তমান দুই মুখ্য কর্মকর্তার (পিও) মধ্যে ওভারটাইম (ওটি) ও নতুন জাহাজ রেজিস্ট্রেশনের ডকিং সুপারভিশন ফি বাবদ ১৮ লাখ টাকা নিয়ে চিঠি চালাচালি শুরু হওয়ার পর এসব অনিয়মের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।
সাবেক মূখ্য কর্মকর্তা (পিও) প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম তার বকেয়া পাওনা দাবি করে গত বছরের ৫ জুলাই বর্তমান পিওর কাছে আবেদন করেন। যার অনুলিপি নৌ সচিব ও নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও দেওয়া হয়েছে। এর জবাবে বর্তমান পিও ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ আলাদা দুটি চিঠিতে সাবেক ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন না করে অবৈধভাবে প্রায় ১৮ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেন। এই টাকা দ্রুত সরকারি কোষাগারে জমা দিতেও বলা হয় চিঠিতে।
বিষয়টি তদন্তের জন্য নৌ পরিবহন অধিদপ্তর গত বছরের জুলাইয়ে একটি কমিটি গঠন করে। গত বছরের ১৯ ও ২০ অক্টোবর সংশ্নিষ্ট দপ্তর পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও এখনও প্রতিবেদন জমা দেননি কমিটির সদস্যরা। তবে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
শফিকুল ইসলাম তার আবেদনে জানান, তিনি ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ছয়টি নতুন জাহাজ ও উপকূলীয় বিভিন্ন জাহাজসহ সিটি গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপের আরও কয়েকটি জাহাজের প্রভিশনাল রেজিস্ট্রেশন সনদ জারি করেন। এসব জাহাজের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম তার তত্ত্বাবধানে হওয়ায়, তার যাবতীয় সুপারভিশন ফি পাওয়ার কথা। ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় 'জাতীয় স্বার্থে' তাকে ওই কাজ করতে হয়েছিল বলেও আবেদনে জানান তিনি। তবে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সময় কীভাবে বাংলাদেশে ডকইয়ার্ড পরিদর্শন ও জাহাজের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সুপারভিশন করা সম্ভব, তা উল্লেখ করা হয়নি আবেদনে।
এদিকে সাবেক পিও শফিকুল ইসলাম পাওনা টাকা দাবি করে গত বছরের ৫ জুলাই নৌবাণিজ্য দপ্তরের বর্তমান পিও ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদের কাছে আবেদন করলেও তিনি এ বিষয়ে নিশ্চুপ ছিলেন। আবেদন পাওয়ার তিন মাস সাত দিন এবং নৌ অধিদপ্তর কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠনের প্রায় আড়াই মাস পর ১২ অক্টোবর শফিকুল ইসলাম বরাবর আলাদা দুটি চিঠি ইস্যু করেন পিও গিয়াসউদ্দিন।
একটি চিঠিতে বলা হয়, শফিকুল ইসলাম সরেজমিন পরিদর্শন না করে সিটি গ্রুপের ১০টি জাহাজের বিপরীতে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে সুপারিভিশন বাবদ প্রতি জাহাজ থেকে এক লাখ ৭৫ হাজার করে মোট ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা অবৈধভাবে নিয়েছেন। এ ছাড়া বিএসসির ছয়টি নতুন জাহাজের বিপরীতে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে প্রভিশনাল রেজিস্ট্রেশন সনদ জারি করেছেন। তবে সেসব জাহাজ তিনি সরেজমিন পরিদর্শন করেননি।
গিয়াসউদ্দিনের অন্য এক চিঠিতে জানানো হয়, সাবেক পিও শফিকুল ইসলাম জাপান থেকে আমদানি করা 'এমটি কুরেনাই মারু (সি-২০৩০)' জাহাজের বিপরীতে সুপারভিশন ফি বাবদ ৪৩ হাজার ৯৯০ টাকা নিয়েছেন। অথচ তিনি কখনও ওই জাহাজ পরিদর্শন করেননি। এভাবে তিনি মোট ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯০ টাকা তুলে নিয়েছেন। এসব টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য শফিকুল ইসলামকে অনুরোধ করেন গিয়াসউদ্দিন। চিঠিতে তিনি এও দাবি করেছেন, এই ১৮ লাখসহ ওইসব জাহাজের যাবতীয় সুপারভিশন ফি তার (বর্তমান পিও) নিজের প্রাপ্য।
এভাবে বিদেশে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় ডকিং সুপারভিশন ফি ও রেজিস্ট্রেশন ফি দাবি করায় সাবেক পিও শফিকুল ইসলামের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একইভাবে নৌ অধিদপ্তর থেকে তদন্ত কমিটি গঠনের দুই মাস পর শফিকুল ইসলামের কাছে টাকা ফেরত চেয়ে একই তারিখে আলাদা দুটি চিঠি দেওয়ায় এবং ওই টাকা নিজে পাবেন বলে উল্লেখ করায় বর্তমান পিও গিয়াসউদ্দিনের ভূমিকাও রহস্যের সৃষ্টি করেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের পর সেই কমিটিকে পাস কাটিয়ে অধস্তন কোনো কর্মকর্তা সংশ্নিষ্ট বিষয়ে এমন চিঠি দিতে পারেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এই চিঠি চালাচালির বিষয়ে অনুসন্ধানে নৌবাণিজ্য দপ্তরে আরও বেশ কিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার তথ্যও মিলেছে। শফিকুল ইসলাম ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চার বছরে বেতনের বাইরে ওভারটাইম ও সুপারভিশন ফি বাবদ দুই কোটি ১০ লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করেছেন!
শফিকুল ইসলাম ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার পর ওই বছরের ১ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত পিওর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট প্রকৌশলী সাজিদ হোসেন। সে সময় প্রকৌশলী সাজিদ হোসেনও বিভিন্ন জাহাজ সার্ভে দেখিয়ে ওভারটাইম ও সুপারভিশন ফি নিয়েছেন। অথচ তিনি পেশাদার সার্ভেয়ার নন। বিধি অনুযায়ী, অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি শুধু 'দায়িত্ব ভাতা' পাবেন।
এ প্রসঙ্গে নৌবাণিজ্য দপ্তরের সাবেক মুখ্য কর্মকর্তা (পিও) শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারি সব নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই প্রাপ্য সুপারভিশন ফি চেয়ে আবেদন করেছেন তিনি। এর পর নৌ পরিবহন অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি করেছে। এ ছাড়া নৌবাণিজ্য দপ্তরে বর্তমান মুখ্য কর্মকর্তা তাকে দুটি চিঠি দিয়েছেন। সে চিঠির জবাবও দিয়েছেন তিনি।
বর্তমান পিও ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, বকেয়া টাকা চেয়ে সাবেক পিও শফিকুল ইসলামের করা আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তিনি বিধি লঙ্ঘন করে কয়েকটি জাহাজের বিপরীতে সুপারভিশন ফি বাবদ বেশ কিছু টাকা নিয়েছেন। তাকে চিঠি দিয়ে ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি আজও তা দেননি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জসিমউদ্দীন সরকার বলেন, নানা ব্যস্ততার কারণে তদন্ত প্রতিবেদন এখনও জমা দেওয়া হয়নি। তবে প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে এবং খুব শিগগির মহাপরিচালকের কাছে জমা দেওয়া হবে।