ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

২৩০ পৌরসভায় নির্বাচন

আস্থার সংকট কাটল না

আস্থার সংকট কাটল না

ছবি: ফাইল

মসিউর রহমান খান

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ মার্চ ২০২১ | ১৬:০২

সদ্য সমাপ্ত পৌর ভোটে দেশের চলমান নির্বাচন ব্যবস্থার কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। ক্রমেই আরও একপেশে হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে কোনো দল প্রতিযোগিতাই গড়ে তুলতে পারছে না। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অবস্থান ক্রমাগত তলানির দিকে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২৩০টি পৌরসভায় নির্বাচন হয়েছে; এর মধ্যে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে একটিতে। সংসদের বাইরের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপির প্রার্থীরা জিতেছেন ১১টিতে। আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ১৮৫টিতে।

৯ বছর আগেও পৌর নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা হয়েছে। ২০১১ সালে ২৫৪ পৌরসভায় নির্বাচনে বিএনপি জিতেছিল ১১১টিতে, আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছিল ১২১টিতে। জয় কম পেলেও ভোট পাওয়ার হারে বিএনপি এগিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহীরা মিলে পেয়েছিল প্রায় ২৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ ভোট। বিএনপি ও এর বিদ্রোহীরা মিলে পেয়েছিল ২৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৫ সাল থেকে এ অবস্থায় হঠাৎ বিশাল পরিবর্তন দেখা যায়। বিরোধীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

বিশ্নেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতির কারণে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর জনমনে আস্থার সংকট তো কাটলই না, বরং আরও বেড়েছে। এটি দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে।

তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে পৌর ভোটে এর বাইরে কিছুই ঘটেনি। বরাবরের মতোই নির্বাচন কমিশন তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে রুটিন কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ইসির কোনো প্রভাব আছে বলে এবারও মনে হয়নি। কিছু কিছু স্থানে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিদ্রোহীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেও অন্য রাজনৈতিক দলগুলো পাত্তাই পায়নি।

ইসি সচিবালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এবারের পৌর নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছেন ৩২টিতে। জাসদ একটি পৌরসভায় মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছে। বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে ৯৩ জন জামানত হারিয়েছেন। জামানত হারোনার এই তালিকায় আওয়ামী লীগেরও রয়েছে তিন প্রার্থীর।

নির্বাচন কমিশন সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা ভোটের ধারাবাহিকতায় এবার আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে ৫ ভাগ। অন্যদিকে বিএনপির ভোট কমেছে ৬ ভাগ। পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ২৩০ পৌরসভায় ৭৭ লাখ ২৪ হাজার ৮৯৭ ভোটারের মধ্যে ৪৯ লাখ ৭২ হাজার ৯৬৭ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ভোটার উপস্থিতির গড় হার ৬৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ২৯ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৫ ভোট। শতকরা হিসেবে ৫৯ দশমিক ৯২ ভাগ। বিএনপি পেয়েছে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬ ভোট। শতকরা হিসেবে ২১ দশমিক শূন্য ৩ ভাগ। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা পেয়েছেন ৯ লাখ ৪৭ হাজার ১০৬ ভোট (শতকরা ১৯ ভাগ)।

২০১৫ সালের পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৫৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বিএনপির ভোটের হার ছিল ২৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ওই সময়ে ২৩৫টি পৌরসভার মধ্যে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ১৮২টিতে এবং বিএনপি ২৪টিতে বিজয়ী হয়েছিল।

২০১৫ সালের ভোটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২ জন এবং বিএনপির ৩৫ জন মেয়র প্রার্থী জামানত হারান। নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগ ভোট না পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সমকালকে বলেন, বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলো তারা স্বীকারই করছে না। তাহলে তারা কোনো ভালো নির্বাচনের পদক্ষেপ নেবে এমন আশা করার সুযোগ নেই।

এবারের পৌর ভোটের ফল নিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিএনপি দীর্ঘদিন থেকেই রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। সেখানে তাদের প্রার্থীরা ভালো ফল করবেন সেই আশা কেউ করে না। তবে ৯৩ জন প্রার্থীর জামানত হারানোর বিষয়টি গবেষণার প্রয়োজন।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এবারের পৌর ভোট দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। হয়তো বর্তমান কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনী অনিয়মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে; নয়তো তাদের বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

তিনি বলেন, সরকার সমর্থকরাও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যেখানে প্রকাশ্যে কথা বলছে; সেখানে কমিশনের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, 'নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই।' তার মতে, এবারের পৌর নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে।

প্রথম ধাপ: ২৮ ডিসেম্বর

এই ধাপে অনুষ্ঠিত ২৪ পৌর নির্বাচনের সব ক'টিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হয়। এতে মেয়র পদে উপস্থিত ভোটের ৬৪ দশমিক ০৬ শতাংশ ভোট পান আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ২৪টির মধ্যে ১৯টিতেই তারা জয়ী হয়। বিএনপির প্রার্থীরা পান ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ ভোট। দুটিতে বিজয়ী হয়েছেন তারা। ১২টিতে বিএনপির প্রার্থীরা জামানত হারান। এ ছাড়া তিনটিতে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এই ধাপে সর্বোচ্চ ৮৫ দশমিক ৩১ ভাগ ভোট পড়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পৌরসভায়। সবচেয়ে কম ৪০ দশমিক ৮৭ ভাগ ভোট পড়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌরসভায়।

দ্বিতীয় ধাপ: ১৬ জানুয়ারি

মেয়র পদে মোট ভোটের ৬০ দশমিক ০৩ শতাংশ পান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এ ধাপে ৪৫টিতে দলটির প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হন। অপরদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা পান ১৭ দশমিক ৯১ শতাংশ ভোট। দলটির মাত্র চারজন মেয়র পদে নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে বাকি ২২ দশমিক ০৬ শতাংশ ভোট পান। দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভায় ভোট পড়েছে ৬১ দশমিক ৯২ শতাংশ।

তৃতীয় ধাপ: ৩১ জানুয়ারি

এ ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের তুলনায় অর্ধেকের কম ভোট পেয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। ৬১টি পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা পেয়েছেন আট লাখ ৩১ হাজার ৩৬৯ ভোট; যা মেয়র পদে পড়া ভোটের ৬১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। দলটির দু'জন মেয়র প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থীরা পেয়েছেন তিন লাখ ৯৯ হাজার ৯১১ ভোট; যা প্রদত্ত ভোটের ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। দলটির ২৭ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

চতুর্থ ধাপ: ১৪ ফেব্রুয়ারি

চতুর্থ ধাপের ৫৪টি পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান অনেক বেশি। এর মধ্যে ৫২টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৫৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। অপরদিকে বিএনপির প্রার্থীরা পেয়েছেন ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট। এ নির্বাচনে বিএনপির ২৩ জন মেয়র প্রার্থী তাদের জামানত হারিয়েছেন। এতে আরও দেখা গেছে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) তুলনায় কাগজের ব্যালটে পৌরসভাগুলোতে গড়ে বেশিসংখ্যক ভোট পড়েছে।

পঞ্চম ধাপ: ২৮ ফেব্রুয়ারি

এ ধাপে ২৮টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। অপরদিকে একটিতে বিএনপি প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী একটিতে জয় পেয়েছেন। এর আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাদারীপুরের শিবচর, চট্টগ্রামের মিরসরাই ও রাউজানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পান।

আরও পড়ুন

×