ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

জীবন দিয়ে হলেও পাহাড় রক্ষার অঙ্গীকার ম্রোদের

জীবন দিয়ে হলেও পাহাড় রক্ষার অঙ্গীকার ম্রোদের

ঐতিহ্যবাহী ম্রো বাঁশিতে একই সঙ্গে কান্না আর দ্রোহের ধ্বনি তুলে জানিয়ে গেছেন ২৫ মার্চের মধ্যে চিম্বুকে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি। ছবি: সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২১ | ০৬:১৮

মানুষগুলো কখনও ঢাকায় আসেননি। আসার কথা ভাবেননি। শুধু রাজধানী ঢাকার নাম শুনেছেন, চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো জনজাতির এই মানুষেরাই মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের ভূমি রক্ষার আবেদন জানাতে। ঐতিহ্যবাহী ম্রো বাঁশিতে একই সঙ্গে কান্না আর দ্রোহের ধ্বনি তুলে জানিয়ে গেছেন ২৫ মার্চের মধ্যে চিম্বুকে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা না হলে যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির দায় নিতে হবে সরকারকে। 

শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে চিম্বুক পাহাড় ম্রো ভূমি রক্ষা আন্দোলনের এই আয়োজনে সমর্থন জানাতে যুক্ত হয়েছিল আরো অনেক সংগঠন। বক্তব্য রেখেছেন সুধীজনদের অনেকেই। সবার সব কথা ছাপিয়ে উচ্চারিত হলো মেনাচিত ম্রোর বক্তব্য। তিনি সম্ভবত প্রথম কোনো ম্রো, যিনি রাজধানী ঢাকায় নিজের ভাষায় বক্তব্য রাখলেন। অবশ্য তার বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করে দিলেন ম্রোদেরই এক তরুণ রেং ইয়ং ম্রো।

মেনাচিতের দাবি, জীবন দিয়ে হলেও পাহাড় রক্ষা করবে ম্রোরা। তিনি বলেন, 'আমরা শত শত বছর ধরে চিম্বুকে বাস করছি। এর আগে আমাদের জুমভূমি নষ্ট করে নীলগিরিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আমাদের একটা প্রাকৃতিক পানির উৎস আমরা দেখিয়ে দিয়েছিলাম, এখন সেখানে বাঁধ দিয়ে আমাদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বছরে ছয় মাস খাবার পানির কষ্টে ভুগতে হয় আমাদের।' 

পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি আরো বলেন, 'আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বলে এখানে এসেছি। আমাদের পাহাড় যদি নিয়েই নেবে, তবে আমাদের সব ম্রোকে মেরে ফেলো। আমরা বেঁচে থাকলে, আরো অনেক বছর ধরে প্রতিবাদ করা লাগলেও করে যাবো।'

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, 'ম্রোরা যে উন্নয়ন চায় না, জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে কেন সেখানে হোটেল নির্মাণের নামে উন্নয়ন করতে হবে! জাতিসংঘসহ সারাবিশ্ব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ম্রো ভাইদের সংগ্রামে সংস্কৃতিকর্মীরা পাশে ছিল, সবসময় থাকবে।'

চিম্বুক পাহাড় ম্রো ভূমি রক্ষা আন্দোলনের আয়োজনে সংহতি সমাবেশের একাংশ। ছবি: সমকাল

আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, 'সিকদার গ্রুপের মতো কিছু লুটেরা গ্রুপ বাংলাদেশের মালিক বনে গেছে। পাহাড়ে তাদের ২০ একর জমি দেওয়া হয়েছে, এই অধিকার জেলা পরিষদকে কে দিয়েছে? সিকদার গ্রুপের জন্য এয়ারপোর্ট খোলা থাকে, ইমিগ্রেশন খোলা থাকে, ব্যাংক লুটের অনুমতি থাকে। পার্লামেন্ট থেকে যদি একজন-দুইজনও আমরা থাকি, তবুও আপনাদের পাশে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে যাবো।'

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'সংবিধান অনুযায়ী পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। এমন হোটেলই যদি বানাতে হয়, তাহলে সংবিধান পরিবর্তন করে লিখে দেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা হোটেল-রিসোর্ট রেখে যেতে চাই। বান্দরবান নিজেই একটা ইকো রিসোর্ট, সেখানে নতুন করে রিসোর্টের প্রয়োজন নাই। বলা হচ্ছে, ম্রোরা নাকি হোটেল নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে, কথাটা কি সত্যি?' তখন সমাবেশে উপস্থিত সবাই সমস্বরে 'না' বলেন।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, 'স্বাধীনতার জন্য আমরা আদিবাসীরাও রক্ত দিয়েছি। গত পঞ্চাশ বছরে আমরা কী পেয়েছি? আমাদের নতুন করে হিসেব-নিকেশ করার প্রয়োজন আছে।'

বান্দরবানের চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের নামে ম্রো আবাসভূমি দখলের প্রতিবাদে সংহতি সমাবেশটি পরিচালনা করেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংহতি সভায় বক্তব্য দেন- মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, আদিবাসী যুব ফোরামের আহ্বায়ক অনন্ত বিকাশ ধামাই প্রমুখ।

সংহতি সমাবেশ শেষে চিম্বুক পাহাড় ম্রো ভূমি রক্ষা আন্দোলনের মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর ঘুরে ফের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এসে শেষ হয়। সেখান থেকে আন্দোলনকারীদের চার সদস্যের প্রতিনিধি দল দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেন।

আরও পড়ুন

×