ফিরে দেখা ১৭ এপ্রিল ১৯৭১
ওরা ১২ জন...

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনারে অংশ নেন ১২ জনের একটি দল। তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন কেবল (বাঁ থেকে) আজিমুদ্দিন শেখ, সিরাজ উদ্দিন ও হামিদুল হক -সমকাল
ফারুক হোসেন, মেহেরপুর
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২১ | ২১:০৬
১৭ এপ্রিল-একাত্তরের এই দিনে মেহেরপুরের মুজিবনগরে সম্পন্ন হয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের অপরিহার্য জরুরি একটি কাজ। এদিন এ দেশের মুক্ত মাটিতে বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর-দেশের অস্থায়ী রাজধানী। কালক্রমে এই নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুজিবনগর সরকার নামে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে প্রথম বাংলাদেশ সরকার।
সেদিন মেহেরপুরে স্বাধীন দেশের নবগঠিত এই সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অনাড়ম্বর, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে গার্ড অব অনারে অংশ নেন মেহেরপুরের ১২ জন আনসার সদস্য। অন্যদিকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে রীতি অনুযায়ী সেদিন গার্ড পরিদর্শন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও গার্ড দলের গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
এই ১২ জন আনসার সদস্যের মধ্যে নয়জনই প্রয়াত এখন। জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে আছেন এখনও তিনজন। তবে তাদের দাবি, মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে তাদের অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিযুক্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। দ্রুত সঠিক ইতিহাস সন্নিবেশন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তা জানানোর দাবি জানান তারা।
গার্ড অব অনার প্রদানকারী জীবিত এই তিন আনসার সদস্য হলেন- মুজিবনগর উপজেলার ভবেরপাড়া গ্রামের মো. আজিমুদ্দিন শেখ, সিরাজ উদ্দিন ও সোনাপুরের হামিদুল হক। অন্যদিকে মৃত্যু ঘটেছে ইয়াদ আলী, মহিউদ্দিন, ফকির মহাম্মদ, অস্থির মল্লিক, কেসমত বিশ্বাস, মফিজ উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, লিয়াকত আলী ও সাহেব আলীর।
এ প্রসঙ্গে আজিমুদ্দিন শেখ বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল হঠাৎ করে সকালে তৎকালীন এসডিও (বর্তমান সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা) তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী আমাদের ইপিআর ক্যাম্পে এসে বললেন, এখানে বেশ কিছু বিদেশি অতিথি আসবেন। তোমাদের আনসার ক্যাম্পে চার পাওয়ালা চৌকি আছে, ওগুলো সংগ্রহ করে একটি মঞ্চ তৈরি কর। এলাকার বিভিন্ন বাড়ি থেকে চেয়ার নিয়ে এসে তাদের বসার ব্যবস্থা কর। একই নির্দেশ দিয়ে যান মুজিবনগর সংগ্রাম কমিটির সংগঠকরা। সেই সময় এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করছিলেন ছহিউদ্দিন বিশ্বাস (বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমপির বাবা) আমাদের নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন, যে কোনো মূল্যে দেশের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। তার সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সংগ্রাম কমিটির সভাপতি জোয়াদ মাস্টার ও সাধারণ সম্পাদক আয়ুব ডাক্তার, স্থানীয় মানুষজনসহ আমরা আনসার সদস্যরা সন্ধ্যার পর মঞ্চ তৈরির কাজ করলাম। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অতিথিদের চেয়ার সংগ্রহ করলাম। হঠাৎ রাত ১১টার পর থেকে বর্তমান স্বাধীনতা সড়ক হয়ে শাঁ শাঁ গতিতে ভারত থেকে অসংখ্য গাড়ি এলো আমবাগানে। প্রতিটি আমগাছের গোড়ায় অবস্থান নিল সিভিল ড্রেসে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত সেনা।
আজিমুদ্দিন শেখ বলেন, সকালে এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আমাদের বললেন, তোমরা কি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের গার্ড অব অনার প্রদান করতে পারবে? উত্তরে 'হ্যাঁ' বললে তিনি আমাদের প্যারেড পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। সকাল থেকেই বড় বড় ক্যামেরা নিয়ে আমবাগানে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক আসতে শুরু করলেন। অবশেষে জাতীয় চার নেতা শপথ নিলেন। আমরা গার্ড অব অনার প্রদান করার সময় ১২ জনের একজন কমান্ড দিলে লাইন বেমানান হয়ে যাচ্ছিল। এ সময় আমাদের মধ্যে ঝিনাইদহের তৎকালীন এসপি মাহাবুব এসে উপস্থিত হন এবং আমাদের কমান্ডের দায়িত্ব দেন। আমরা তখন মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করি।
এ প্রসঙ্গে আনসার সদস্য সিরাজ উদ্দিন বলেন, আমরা মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করলেও বছরের পর বছর কেউ কোনো খোঁজখবর রাখেনি আমাদের। ১৯৯৪ সালে হঠাৎ আমাদের অনুসন্ধান করা হয়। গ্রামের কয়েকজন মানুষ আমাদের জানায়, শফিপুর আনসার একাডেমি থেকে তোমাদের কয়েকজন লোক খোঁজ করছেন। তখন আমরা ভয়ে পরিচয় দিতে চাচ্ছিলাম না। তবে একসময় তাদের উদ্দেশ্য বুঝে তাদের কাছে আমাদের সে সব দিনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরি। পরে তারা ১৯৯৬ সালে একাডেমিতে নিয়ে গিয়ে আমাদের পদক ও সম্মাননা প্রদান করেন। একই বছর মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ফারুক আহাম্মেদ আমাদের গার্ড অব অনার প্রদানকারী প্রত্যেক আনসার সদস্যের নামে ৫০ শতাংশ করে জমি বরাদ্দ দেন।
সিরাজ উদ্দিন বলেন, তখন আমরা বুঝতে পারিনি, কাকে কীভাবে জমি দেওয়া হচ্ছে। জমির দলিল নেওয়ার পর দেখি ছয়জনের জমি ঠিক আছে। বাকি ছয়জনকে অন্যের রেকর্ডীয় জমি দেওয়া হয়েছে। যাদের নামে রেকর্ডীয় জমি তারা তা নিয়ে নিয়েছেন। এর ফলে আমি ও জীবিত আরেক সদস্য হামিদুল হক জমি পাইনি। প্রয়াত মহিউদ্দিন, ফকির মহাম্মদ, মফিজ উদ্দিন এবং নজরুল ইসলামও কোনো জমি পাননি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ নিয়ে অনেক দেনদরবার করেও এখনও জমি বুঝে পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, সরকার থেকে প্রতি মাসে আমাদের ১২ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। তবে তাদের বয়সকে বিবেচনায় নিয়ে এই ভাতা বাড়ানোর অনুরোধ করেন তিনি।
অপর আনসার সদস্য হামিদুল হক বলেন, আমরা বেঁচে থাকতেই আমাদের ঐতিহাসিক মুজিবনগরে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে ১২ জন আনসার সদস্যের জায়গায় আটজনের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। আনসার সদস্যদের কারও সঙ্গেই এই ভাস্কর্যগুলোর কোনো মিল নেই। অথচ অন্যান্য ভাস্কর্য দেখে ঠিকই বোঝা যায়, সেগুলো কাদের। তাদের নাম-পরিচয়ও সেখানে লিপিবদ্ধ করা আছে। শুধু আমাদের বেলায়ই রয়েছে অমিল, লিপিবদ্ধ করা হয়নি আমাদের কারও নামপরিচয়। আমাদের দাবি, আমরা বেঁচে থাকতেই আমাদের মুজিবনগরে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হোক। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ভুলভাবে চিনবে, জানবে। এ ছাড়া সরকারের কাছে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
হামিদুল হক বলেন, ১৭ এপ্রিল আমাদের অনেক আনন্দের দিন। তবে গত বছর থেকে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এই দিবসের সব আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ রয়েছে। জানি না আগামী বছর পর্যন্ত বাঁচব কিনা। শুনতে পাচ্ছি, মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নতুনভাবে সাজানো হবে। আমাদের দাবি, আমরা যেন বেঁচে থাকতে সঠিক ইতিহাসটি দেখে যেতে পারি।
এসব প্রসঙ্গে মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খাঁন বলেন, গার্ড অব অনার প্রদানকারী আনসার সদস্যদের সব সময় খোঁজখবর রাখা হয়। তাদের মধ্যে যারা জমি পাননি, তাদের জন্য জমি খুঁজতে মুজিবনগর ভূমি অফিসকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারি খাসজমি পেলেই বরাদ্দ দেওয়া হবে। জেলা প্রশাসন সব সময় তাদের পাশে আছে। ভাস্কর্যে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে তাও ভবিষ্যতে সংশোধন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ঐতিহাসিক মুজিবনগরকে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। মুজিব নগরকে নতুন আঙ্গিকে সাজানো হবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমপি বলেন, বর্তমান সরকার মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের আধুনিকায়নের কাজ হাতে নিয়েছে। দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী মুজিবনগরে এসে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস জানতে পারবেন। এখানে পরিভ্রমণের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জেনে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। আনসার সদস্যদের ভাস্কর্য সঠিকভাবে নির্মাণ করে নাম ঠিকানাসহ উপস্থাপন করা হবে।
- বিষয় :
- মুজিবনগর সরকার