'প্রেরণার কথা'য় আসাদুজ্জামান নূর: এক কিংবদন্তির গল্পকথা

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২১ | ০২:৩৭
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক জগতের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র, অভিনেতা, জাতীয় সংসদে সাধারণ মানুষের একজন প্রতিনিধি, যার প্রখর রসবোধ এবং বিনয়ী আচরণের জন্য মানুষ তাকে আপন করে নিয়েছে, সেই আসাদুজ্জামান নূর, এমপি তার উপস্থিতি দিয়ে আলোকিত করেছিলেন প্রেরণার কথার দ্বিতীয় সিজনের প্রথম পর্ব।
এই আলাপচারিতায় তিনি তার শৈশব, জীবনদর্শন, অভিনয় জীবনের শুরু, জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, তার সাহসের উৎস, দেশের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার গল্প এবং দেশের ভবিষ্যৎ ও নতুন প্রজন্ম নিয়ে তার চিন্তাভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করেছেন।
১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে। কিন্তু ঢাকায় এসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকদের থেকে দেশকে মুক্ত করার গণআন্দোলনে জড়ানোর মাধ্যমে রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ তাকে সাহস এবং প্রেরণা জোগায় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। সেই ভাষণের দিক-নির্দেশনা পেয়ে তিনি ৮ মার্চ তার জন্মস্থান নীলফামারী চলে যান এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেন। পরবর্তীকালে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
অভিনয় জগতে আসাদুজ্জামান নূরের শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা আলী যাকেরের নাট্যদল 'নাগরিক'-এ যোগদানের মাধ্যমে। সেখানে প্রথমদিকে পর্দার পেছনে কাজ করলেও হঠাৎ একজন অভিনেতা আহত হয়ে গেলে ঘটনাচক্রে তাকে সেই চরিত্রটি করতে হয়। এটাই তার মঞ্চ নাটকের অভিষেক। এরপর ১৯৭৪ সালে স্বনামধন্য নাট্যকার এবং চলচিত্র নির্মাতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের 'রঙের ফানুস' নাটকে তার টিভি পর্দায় অভিষেক হয়।
আলাপকালে তিনি বলেন, তার অভিনীত অজস্র চরিত্রগুলোর মধ্যে তার প্রিয় চরিত্র 'মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া' নাটকের 'নান্দাইলের ইউনূস' এবং তার প্রিয় ধারাবাহিক নাটক হল 'অয়োময়'। অভিনেতা হিসেবে তিনি সবসময় বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছেন। বাড়ির চাকর থেকে শুরু করে জমিদার কিংবা পেশাদার খুনি, সবরকম চরিত্রই তিনি করেছেন।
এই অভিনেতা বিশ্বাস করেন একটি দেশকে সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে হলে সংস্কৃতিই হল সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। বহির্বিশ্বের সামনে দেশকে তুলে ধরায় সাংস্কৃতিক কূটনীতির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন, সবারই তার নিজের সংস্কৃতির সাথে যুক্ত থাকা উচিত কারণ মানুষকে ইতিবাচক চিন্তার মধ্য দিয়ে একত্র করতে রাজনীতির চেয়ে সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। তিনি মনে করেন সেটা করার জন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মকে উদার ও মুক্ত চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতি ও শিল্পের প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি করে সেটাকে লালন করতে হবে।
'আমি যে কথা সব সময় বলার চেষ্টা করি সেটা হল যে জাতিগত পরিচয়ের বাইরেও আমাদের যে জাতি গঠনের জায়গাটা আছে।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের নতুন প্রজন্মকে সত্যিকার অর্থে একজন দেশপ্রেমিক, একজন বাঙালি মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির একটা সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। না হলে প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলা কঠিন হবে।'
দুইটি ঘটনাকে তিনি তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন। প্রথমটি হচ্ছে ৪৯ বছর আগে অনন্য অভিনেতা আলী যাকেরের সাথে তার পরিচয়। এই কিংবদন্তি অভিনেতার হাত ধরেই তার অভিনয় জগতে প্রবেশ। পরবর্তীকালে আলী যাকেরের সাহায্যেই তিনি বিজ্ঞাপন জগতে আসেন এবং বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন ও যোগাযোগ শিল্পে ব্যাপক অবদান রাখেন।
তার জীবনের দ্বিতীয় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে তিনি রাজনীতিতে পদার্পণকে উল্লেখ করে বলেন, 'আর সেকেন্ড টার্নিং পয়েন্ট যদি মনে করেন, তাহলে সেটি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কারণ আমার যে রাজনৈতিক জীবন, এটা তার কারণেই হয়েছে। তিনিই আমাকে এই রাজনীতিতে নিয়ে এসেছেন।'
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আসাদুজ্জামান নূর দেশকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর আমাদের দেশের উত্তাল রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোকে তিনি বলেন, শুরু থেকেই সঠিক পথে থাকলে আমাদের দেশ আজকে উন্নয়নের যেই পর্যায়ে আছে সেখানে হয়তো আমরা আরও ৩০ বছর আগে থাকতাম।
স্বপ্ন এবং তার পরিবর্তনশীলতা নিয়ে এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বলেন, 'স্বপ্ন এমন একটা জিনিস, যে দশ বছর আগে যে স্বপ্নটা আমি দেখেছি, আমার পরের প্রজন্ম কিন্তু সে একই স্বপ্ন দেখবে না, তারা নতুন স্বপ্ন দেখবে। মানুষের ব্যক্তিগত উন্নয়নের জায়গাটা কিন্তু থেমে থাকে না। এটা এমন না যে আমি এখানে পৌঁছে গেছি, আমার আর কোনো উন্নয়নের দরকার নেই। স্বপ্ন দেখাটা চলতেই থাকবে এবং এই স্বপ্ন দেখাটাই কিন্তু মানুষকে বাচিয়ে রাখে।'
স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেধার চেয়ে পরিশ্রমের ওপর বেশি জোর দেন। তিনি মনে করেন মেধা গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রতিশ্রুতি, ধৈর্য, এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে মেধার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। 'আমাদের একটা প্রবণতা আছে যে সবকিছু আমরা খুব দ্রুত পেতে চাই। এই দ্রুত পাওয়ার প্রবণতাটা বাদ দিয়ে পরিশ্রম, উদ্যোগী ভূমিকা এবং সততার সঙ্গে নিজের কাজটি করা উচিত। এই সততা শব্দটার অর্থ অনেক গভীর। এটা শুধু আর্থিক সংজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমরা যেখানে যেই কাজটি করছি, তার মধ্যে সততা থাকতে হবে। এই সততাটা যদি থাকে আমাদের সবার মধ্যে, তাহলে কিন্তু আমাদের যাই স্বপ্ন থাকুক না কেন, সেই স্বপ্ন আমরা অর্জন করতে সক্ষম হব।'
নিজের লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাওয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেতা বলেন, তার জীবনে কোনো অনুশোচনা নেই। 'আমি যে কাজটা করতে চাই, সেটি আমি আমার ১০০ ভাগ আন্তরিকতা দিয়ে করার চেষ্টা করি। যদি ব্যর্থ হই, আমার কিছু করার নেই। আমি চেষ্টা করেছি, সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।'
প্রেরণা ফাউন্ডেশনের একটি উদ্যোগ, প্রেরণার কথার অংশ হিসেবে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএর সহযোগী অধ্যাপক ড. মেলিতা মেহজাবিন। প্রেরণার কথার পুরো পর্বটি দেখা যাবে প্রেরণা ফাউন্ডেশনের ইউটিউব চ্যানেলে।