রাজধানীর ৫ এলাকায় ডায়রিয়া রোগী বেশি

প্রতিদিনই বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক মুমূর্ষু রোগীকে - মাহবুব হোসেন নবীন
রাজবংশী রায়
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২২ | ১৪:৪০
রাজধানীতে কলেরা রোগীদের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) সামনে একটু পরপর থামছে অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। আর ওইসব যানবাহন থেকে দুই থেকে তিনজন মিলে একেকজন রোগী নামাচ্ছে। প্রত্যেক রোগীর চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তাদের শরীরী ভাষা দেখেই বোঝা যায়- অন্যের সহায়তা ছাড়া একা হেঁটে চিকিৎসা কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়। হুইলচেয়ারে করে অথবা স্বজনের কাঁধে ভর দিয়ে প্রত্যেক রোগীকে প্রবেশ করতে হচ্ছে। গতকাল শনিবার দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত এক ঘণ্টায় অন্তত একশ রোগীকে এভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা যায়। গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে ডায়রিয়া রোগী বাড়তে শুরু করে। তীব্র গরম ও অনিরাপদ পানি পানের কারণে হঠাৎ করে রোগী বেড়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে আইসিডিডিআর,বি কলেরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীর সংকুলান করতে না পেরে এত দিন হাসপাতালের বাইরে তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। গত শুক্রবার থেকে তাতেও সামাল দেওয়া সম্ভব যাচ্ছিল না। এর পর প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে সংরক্ষিত একটি এলাকায় তাঁবু টানিয়ে রোগী চিকিৎসা কেন্দ্র সম্প্রসারণ করা হয়। সেখানেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
কোথা থেকে আসছে এত রোগী- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হাসপাতালে এক ঘণ্টা অবস্থানকালে রোগীর অন্তত ১০ স্বজনের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাদের ৭ জন যাত্রাবাড়ী এলাকার এবং দু'জন দক্ষিণখান ও একজন বাসাবো এলাকার বাসিন্দা। এই চিত্র তুলে ধরে আইসিডিডিআর,বি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকার মানুষ বেশি। এর পর দক্ষিণখান, বাসাবো, কদমতলী ও মোহাম্মদপুর এলাকার রোগী রয়েছে। এর বাইরে রাজধানীর সায়েদাবাদ, শনিরআখড়া, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, বাড্ডা, উত্তরখান, উত্তরা ও রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকেও রোগী আসছে। আইসিডিডিআর,বিতে ১৬ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল বিকেল ৪টা পর্যন্ত ১৯ দিনে ২১ হাজার ৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৬৭ জন রোগী।
আইসিডিডিআর,বির হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম সমকালকে বলেন, আগের বছরগুলোয় গরমের মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ৭০০-৮০০ রোগী ভর্তি হতো। এবার রোগীর চাপ অনেক বেশি। কোনো কোনো দিন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ অতিক্রম করেছে। ১৬ মার্চ থেকে একদিনও নতুন ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা এক হাজারের নিচে নামেনি। অন্যান্য বছর শিশু রোগী বেশি ভর্তি হতো। এবার ১৮ বছরের বেশি বয়সী রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। ভর্তি রোগীদের মধ্যে তীব্র পানিশূন্যতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তীব্র গরমে অস্বাস্থ্যকর খাবার ও অনিরাপদ পানীয় পান করার ফলে ডায়রিয়ার তীব্রতা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালেও ডায়রিয়া রোগীর ভিড় বাড়ছে। কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত আট থেকে ১০ দিন ধরে ডায়রিয়া রোগীর চাপ বেড়েছে। ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের অধিকাংশই বয়স্ক। শিশুরাও আছে, তবে সংখ্যায় কম।
হঠাৎ করে ডায়রিয়া বৃদ্ধির কারণ কী- এমন প্রশ্নে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসায় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে। একই সঙ্গে তীব্র গরম পড়ছে। তীব্র গরমে খাবারে দ্রুত জীবাণুর জন্ম দেয়। কোন সময়ের পর খাবার খাওয়া উচিত নয়, সেটি অধিকাংশ মানুষ জানে না। গরমের তীব্রতায় রাস্তাঘাটে তৈরি করা লেবুর শরবত পান ও পচাবাসি খাবার গ্রহণ করছে। এসব খাবার ডায়রিয়ার জীবাণুর অন্যতম উৎস। সবাই একসঙ্গে এসব খাবার গ্রহণ করছে এবং ডায়রিয়া রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, করোনাকালে মানুষ নানা ধরনের স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে ছিল। ঘন ঘন হাত পরিস্কার করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সংক্রমণ কমে আসায় ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার প্রবণতা কমেছে। ডায়রিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে খাবার প্রস্তুত, স্পর্শ, পরিবেশন ও খাবার খাওয়ার আগে হাত এবং টয়লেট থেকে বের হয়ে ও বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। কারণ, হাত দিয়ে মানুষ সবকিছু স্পর্শ করে এবং সবচেয়ে বেশি জীবাণু বহন করে। এ ছাড়া ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে পানি। ঢাকার যেসব এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছে, সেখানকার কলের পানিতে সমস্যা রয়েছে। ঢাকায় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মূলত উৎসে পানির মান পরীক্ষা করে। কিন্তু অনেক এলাকায় পানির পাইপ ফুটো হয়ে সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিলে যায়। এটি সারাবছরের সমস্যা। এটি একটি চেইন রিঅ্যাকশনের মতো। এখন তীব্র হচ্ছে।
ডায়রিয়া কীভাবে বোঝা যাবে: একটি সূত্র বলছে, আইসিডিডিআর,বি তাদের হাসপাতালে ভর্তি প্রতি ৫০তম রোগীর মল পরীক্ষা করে ২৩ শতাংশের মতো রোগী কলেরায় আক্রান্ত বলে প্রমাণ পেয়েছে। তবে এটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। প্রতি বছরই ডায়রিয়া রোগীদের মধ্যে কিছু রোগীর মল পরীক্ষা করে তাতে কলেরার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, ডায়রিয়া বা কলেরার মূল কারণ ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া। এটি ছড়ানোর মাধ্যম হচ্ছে জীবাণু দ্বারা দূষিত পানি ও পচা-বাসি খাবার। কিন্তু কলেরার জীবাণুর উপস্থিতি সরকারিভাবে স্বীকার করা হয় না। কলেরা শব্দটি এড়িয়ে মারাত্মক ডায়রিয়া বলা হয়। কলেরা প্রতিরোধে কার্যকরী টিকা রয়েছে। সেটি বছরে দুইবার করে দিতে হয়। কিন্তু দেশের বাস্তবতায় সেটি কঠিন। একই সঙ্গে কলেরায় আগের মতো মানুষ এখন মারা যায় না। কারণ, চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টায় তিনবার পাতলা পায়খানা হলে সেটিকে ডায়রিয়া বলা হয়। শুরুর দিকে বমি, পেট কামড়ানো হয়ে থাকে। এ ছাড়া ডায়রিয়া হলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আর কলেরা হলে সেটিকে রাইস ওয়াটার স্টুল বলা হয়। অর্থাৎ চাল ধোয়া পানির মতো দেখতে প্রচুর পাতলা পায়খানা হয়। বাথরুমে যাওয়ার মতো আর সময় থাকে না। কলেরায় খুব দ্রুতই শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে রোগী দ্রুত নিস্তেজ হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে শকেও চলে যেতে পারেন। সুতরাং কলেরার ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিতে কোনোভাবেই বিলম্ব করা যাবে না। ই-কোলাই থেকে ডায়রিয়া হলে তাতে বমি হবে, পেট কামড়াবে এবং পাতলা মল হবে। রোটা থেকে ডায়রিয়া হলে মলের রং সবুজাভ হবে। শিগেলার হলে অল্প করে নরম মল হবে। একই সঙ্গে মিউক্যাস, রক্ত ও গা গোলানো ভাব থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাড়িতে স্যালাইন খেয়ে চিকিৎসা চালানো যেতে পারে। খুব খারাপ অবস্থা হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তবে সব ধরনের ডায়রিয়ার চিকিৎসা একটাই, সেটি হলো শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া পানি ও লবণ আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। ডায়রিয়া হলে রোগীকে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে। স্যালাইনের পাশাপাশি ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল খাবার দিতে হবে। সুতরাং সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, গরমের এই সময়ে যাতে কেউ বাইরের খাবার গ্রহণ না করে। ঘরে তৈরি খাবার গ্রহণ করা ভালো। একই সঙ্গে ফুটিয়ে পানি পান করতে হবে। তাহলে ডায়রিয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে।
- বিষয় :
- ডায়রিয়া রোগী
- ডায়রিয়া আক্রান্ত
- আইইডিসিআর