রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন
'নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে'

শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয়েছে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন। প্রদীপ প্রজ্বালনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নৃত্য পরিবেশনা-সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২২ | ১৪:৪৫
মানবিক মূল্যবোধ ও উদারনৈতিক সংস্কৃতিচর্চায় প্রেরণা জোগান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির পথে তাঁর বাণী ও কথা যেন আলোকবর্তিকা। কথা, কবিতা ও গানে কবিগুরু সামগ্রিকভাবে বাঙালি নন্দনতত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্বদরবারে। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ আয়োজিত ৪০তম রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবিগুরুর গান, কবিতার সামাজিক তাৎপর্য তুলে ধরতে এসব কথা বলেন শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিজন।
গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ আকরম হোসেন। এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের নির্বাহী সভাপতি আতিউর রহমান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বুলবুল ইসলাম।
কবিগুরুর গান যেন মানুষের মনে আলোর সঞ্চার করে। দূর করে অজ্ঞতার অন্ধকার। তিনি বিশ্বাস করেন, 'নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।'
সকাল সাড়ে ৯টায় বোধনসংগীত 'আপনি অবশ হলি, তবে বল দিবি তুই কারে?'-এর মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এরপর রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ৪০ শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিজনকে মঞ্চে ডেকে নেন সঞ্চালক ত্রপা মজুমদার। তাঁরা একসঙ্গে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বেলে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। পরে সৈয়দ আকরম হোসেন উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন, ভোগ আর অধিকার করার প্রয়াস থেকে আসে প্রতিপক্ষকে নিস্ক্রিয় করার চেষ্টা। এভাবেই শুরু হয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ লড়াই চলছেই। তিনি বলেন, সমাজ-বিচ্ছিন্ন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল 'আমি'। সেই 'আমি'ই তীব্র লালসায় ক্রমশ মানুষের সুকুমার বৃত্তি, কল্যাণবোধ, মানবধর্মকে নষ্ট করতে সচেষ্ট। এ শক্তি গান, শিল্প, সাহিত্য বা সামগ্রিকভাবে নন্দনতত্ত্বের চর্চা নষ্ট করে মানুষকে শাসন-শোষণ ও প্রতিবাদহীন করার প্রয়াস নিয়েছে। তিনি বলেন, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার পেছনে আছে পুঁজিবাদ। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও বাঙালির নন্দনতত্ত্ব জাগিয়ে তুলতে হবে।
'সবুজ গ্রহটা এখন রক্তাক্ত' উল্লেখ করে সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন, এখন মানুষের চিত্তবৃত্তি, মনুষ্যত্ববোধ, নন্দনবৃত্তি, সুকুমার বৃত্তি, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতার জাগরণ ঘটাতে হবে। এ জাগরণ ঘটানোর অন্যতম পন্থা হলো সংগীত। নির্লোভ ও নিরাসক্ত থেকে দ্বৈত সত্তা বর্জন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির আত্মপরিচয় বিকাশে রবীন্দ্রনাথের অবদান তুলে ধরেন আতিউর রহমান। তিনি বলেন, একাত্তরে কোটি মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠে ছিল তাঁর গান। তাঁর স্বদেশি আন্দোলনের অনুরণিত হয়েছে একাত্তরে। তিনি বলেন, 'আমাদের যাত্রা হলো শুরু', 'আমি ভয় করব না ভাই, করব না', 'সার্থক জনম আমার', 'ও আমার দেশের মাটি'সহ অসংখ্য গানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের হীরণ্ময় সময়ে আমরা রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়েছি। তিনি বলেন, বিশ্বে অর্থনৈতিক ও সভ্যতার সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এটা মোকাবিলা করতে রবীন্দ্রনাথ ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। বাঙালির প্রতিদিনের জীবন চলায়ও তিনি প্রাসঙ্গিক।
আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বুলবুল ইসলাম বলেন, সমাজে এখন অশুভ শক্তি প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভুল বার্তা দিয়ে সমাজে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করতে চায়। সেই শক্তিকে ধিক্কার জানানোর পাশাপাশি প্রতিহত করার সময় এসেছে। সম্মেলনজুড়ে সে কথাই বারবার উচ্চারণ করব।
সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় গীতি-আলেখ্য 'তোমায় নতুন করে পাব'। উৎসবের দ্বিতীয় দিন আজ বিকেলে 'সম্প্রীতির সমাজ গঠনে সংস্কৃতির দায়' শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি সারওয়ার আলীর সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন মফিদুল হক; আলোচনায় অংশ নেবেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও অধ্যাপক সাধন ঘোষ।
সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে কাল রোববার বিকেল সাড়ে ৪টায়। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। অধিবেশনে রবীন্দ্র পদক দিয়ে গুণী-সম্মাননা জানানো হবে শিল্পী, শিক্ষক ও সংগঠক নীলোৎপল সাধ্য ও মিতা হককে।
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতায় কিশোর বিভাগের চূড়ান্ত পর্বটি অনুষ্ঠিত হয় গতকাল দুপুরে। এতে ২৯ জন প্রতিযোগী অংশ নেন। বিচারক হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী লিলি ইসলাম, সালমা আকবর, মনসুরা বেগম, অশোক সাহা, তানিয়া মান্নান ও তৌফিক এন্দো। প্রতিযোগীরা প্রত্যেকে দুটি করে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। বিজয়ীদের নাম পরে ঘোষণা করা হবে।
সাধারণ বিভাগের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে আজ সকাল সাড়ে ৯টায়। সম্মেলনের তিন দিনেরই সান্ধ্য-অধিবেশন সাজানো হয়েছে গুণীজনের সুবচন রবিরশ্মি, গীতি আলেখ্য, আবৃত্তি, পাঠ, নৃত্য ও গান দিয়ে।
বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে যথারীতি প্রকাশিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির নানা দিক নিয়ে বিশিষ্টজনের লেখা প্রবন্ধের সংকলন 'সংগীত সংস্কৃতি'।
১৯৭৯ সালে শিল্পী জাহেদুর রহিমের প্রয়াণ দিবসে কাজ শুরু হয় 'জাহেদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ'-এর। দেশব্যাপী বৃহত্তর পরিসরে কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্য নিয়ে পরে বাঙালির চিরকালের সঙ্গী রবীন্দ্রনাথের নাম যুক্ত করে সংগঠনের নামকরণ হয় জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। জাহেদুর রহিমের স্মৃতি ধরে রাখতে 'জাহেদুর রহিম স্মৃতি পুরস্কার' প্রতিযোগিতার আয়োজন রয়েছে এবারও।