‘রাতে লাখপতি ছিলাম ভোরেই পথের ফকির’

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে বৃহস্পতিবার ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় দোকান থেকে উদ্ধার করা কাপড় সরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা -সমকাল
আব্দুল হামিদ
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০৩:৩৫
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ী ফজলুল হক (৬২)। পুড়ে ভষ্মীভূত কাপড়ের দোকানের সামনে বসে অঝোরে কাঁদছেন তিনি। জানালেন, রাত ১০টায় ভালো মার্কেট বন্ধ করে বাসায় যান। ভোররাতে খবর পান মার্কেটে আগুন লেগেছে। তখনই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে আসেন ফজলুল। ৪টা পর্যন্ত তাঁর দোকানে আগুন লাগেনি। তারপরই দাউ দাউ করে আগুনে পুড়তে দেখেন তাঁর দুটি দোকান। আর বলতে পারেননি তিনি। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। বলেন, এটা স্বাভাবিক আগুন না। চোখের সামনে আমার শেষ সম্বলটুকু পুড়ে যেতে দেখলাম। এটা সহ্য করার মতো না।
এই ব্যবসায়ীর দাবি, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারও কাছে সহায়তা চান না তারা। কিন্তু যেই অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় ব্যবসায়ীদের বসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। তিনি বলেন, আমরা পথে বসে গেছি, এখন ঘুরে দাঁড়াতে হলে এই ছাইয়ের মধ্যেই বসতে হবে ব্যবসায়ীদের। তাহলে মহাজনরা ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষি মার্কেটে এখন কোনো দোকান মালিক সমিতির কমিটি নেই। তাদের অভিযোগ, পুরো মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করেন উত্তর সিটি কপোরেশনের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান। এই মার্কেটে তার কথার ওপরে কেউ কোনো কথা বলতে পারেন না। দোকানপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা চাঁদা নিলেও পুরো মার্কেটের জন্য দু’জন নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। আর মাসিক ভাড়া ১২০০ টাকা নেয় সিটি কপোরেশন। সাধারণত ১৬ জন নিরাপত্তাকর্মী থাকার কথা।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে কাউন্সিলর মফিজুর রহমানকে কয়েকবার মোবাইল ফোনে কল দিলেও না ধরায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তাঁর অভিযোগ, মার্কেটের কোনো দোকানের শট সার্কিট থেকে যদি আগুন লেগেই থাকে তাহলে এক পাশ থেকে পুড়তে পুড়তে আসবে। কিন্তু মার্কেটের কয়েকটি স্থান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই মার্কেটে এক শেডে আগুন লাগলেও অন্য শেডে যাওয়ার সুযোগও কম। কারণ একটি শেডের থেকে আরেকটি শেডের মাঝে অনেক দূরত্ব। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার কৃষি মার্কেট সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। এজন্য ব্যবসায়ীরা সাধারণত বুধবারে নতুন মালপত্র কিনে দোকানে রাখেন। বন্ধের দিন মার্কেটে আগুন লাগার বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখছেন তারা। এ ছাড়া ব্যবসায়ী নেতারাও অগ্নিকাণ্ডের দায় সিটি করপোরেশনের ওপরে চাপাচ্ছেন।
দুপুরে কৃষি মার্কেটের মুদি শেডের সামনে কাঁদছেন মধ্য বয়সী নারী নার্গিস বেগম। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর বড় মেয়ে তুষি আক্তার ফাতেমা ও ছোট মেয়ে তাসিয়া তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কথা বলে জানা যায়, সবজি ভান্ডারের মালিক আব্বাস আকনের স্ত্রী তিনি। চার বছর ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ তিনি। তিন সন্তান নিয়ে পাশেই একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তারা। এই দোকানের ওপরেই চলে পুরো পরিবার। এ সময় দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া দোকানের মধ্য থেকে পোড়া আলু, চাল, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন জিনিস সরিয়ে দেখছেন অনেক ব্যবসায়ী। কোনো মালপত্র অক্ষত আছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। পাশেই শরিফ আহমেদ নামে এক মসলা ব্যবসায়ী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।
কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, মোহাম্মদপুরের নিক্কাপাড়ার একটি মেসে থাকেন, গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। পুরো পরিবার তাঁর আয়ের ওপরে নির্ভরশীল। তাঁর দোকান পুড়ে গেছে, সে কথা বাড়িতে বাবা-মাকে জানাননি। শুনলে তারা অসুস্থ হয়ে যাবেন এই ভয় রয়েছে তাঁর। সপ্তাহে বাসায় টাকা পাঠান, সেই টাকায় চলে পরিবার। এই সপ্তাহে কী করে টাকা পাঠাবেন আর কী বলবেন বাবাকে– সেই কথা বলতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে তাঁর। নিজেকে সামলে নিয়ে শরিফ বলেন, দোকানে দেড় লাখ টাকার মালপত্র ছিল। কিস্তিতে ধার নিয়ে মালপত্র তুলেছি। তাদের মতো এমন নিঃস্ব হয়েছেন বিসমিল্লাহ চাল ভান্ডারের মালিক ওবাইদুল ইসলাম সৈকত। তাঁর চারটি চালের দোকান ছিল ওই মার্কেটে। তাঁর অভিযোগ, এই মার্কেটে সিটিটিভি লাগানো আছে, কিন্তু সব নষ্ট। এ ছাড়া পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী নেই। অগ্নিকাণ্ডের পর দুপুরের দিকে ঘটনাস্থলে আসেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির কয়েকজন নেতা।
এ সময় সংগঠনের সভাপতি হেলাল উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, সিটি করপোরেশন যখনই কোনো মার্কেট ভবন করতে চায়, তার কয়েকদিন পরই সেখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দোকান মালিকদের পক্ষ থেকে মার্কেট করতে তো কোনো বাধা নেই। কিন্তু যেসব ব্যবসায়ীর মার্কেটে দোকান আছে, তাদের দোকানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এভাবে ব্যবসায়ীদের পথে বসানোর কোনো মানে হয় না।