সেবা পেতে নগরবাসীর ছোটাছুটি, গলদঘর্ম

কোলাজ
অমিতোষ পাল ও লতিফুল ইসলাম
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:২১ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৪ | ০৮:৪৫
রাজধানীর ফার্মগেটে সেজান পয়েন্টের দোতলায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কার্যালয়। বসতেন কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা কার্যালয়টিতে হামলা চালায়। এরপর ভবন মালিক কক্ষটিতে তালা ঝুলিয়ে দেন। সেই থেকে বন্ধ ওয়ার্ড কার্যালয়টি। বসার জায়গা পাচ্ছেন না ওই ওয়ার্ডের সচিব রিফাত হোসেন। এদিকে প্রতিদিনই লোকজন সেবা নিতে এখানে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান। ফলে সেবা নিতে আসা লোকজন কোথায় গিয়ে অভিযোগ জানাবেন তাও বুঝতে পারছেন না। রিফাত হোসেন বলেন, ‘কাউন্সিলর না থাকলেও একটু বসার জায়গা থাকলে মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু কোথাও বসতে পারছি না, সেবা দেব কীভাবে?’এই ওয়ার্ডে সেবা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি।
গত বুধবার ডিএনসিসির ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ের সামনে পাওয়া যায় কয়েকজন সেবাগ্রহীতাকে। বেশির ভাগই এসেছেন সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে। কারণ কিছুদিনের মধ্যে স্কুলে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে। তখন জন্মসনদ লাগবে। কিন্তু কার্যালয় তালাবদ্ধ দেখে ওয়ার্ড সচিবকে খোঁজেন তারা। অনেকে অবশ্য নাগরিকত্ব সনদ, উত্তরাধিকার সনদ এবং বয়স্ক ও বিধবা ভাতার প্রত্যয়নপত্রের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরই ঢাকার দুই সিটির প্রায় সব ওয়ার্ড কার্যালয়ে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর সিটি করপোরেশন কাউন্সিলরদের অপসারণ করে সরকার।
ডিএনসিসির ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ের (তালতলা-শেরেবাংলা নগর ও পশ্চিম আগারগাঁও) সচিব জাকির হোসেন বলেন, ‘গত ৬ আগস্টে অফিসে এসে দেখি, কম্পিউটার, প্রিন্টার, এসি, টিভি, সোফা, ফ্যান, চেয়ার-টেবিল কিচ্ছু নেই, হামলাকারীরা সব নিয়ে গেছে। পরে একটি চেয়ার ও একটি টেবিল ম্যানেজ করে অফিসটা চালু রেখেছি। কেউ এলে বসতেও দিতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘আগে এক দিনে জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে দিতাম। এখন লাগে সাত দিন। নাগরিকত্বের সনদ দিতে আগে লাগত পাঁচ মিনিট, এখন লাগে পাঁচ দিন।’
কাউন্সিলর না থাকায় ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাউন্সিলরের নাগরিক সেবা নির্দেশ দিয়েছে সরকার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একজন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে ৯টি সাধারণ ও তিনটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হচ্ছে। অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ তো রয়েছেই। ওয়ার্ড কার্যালয়ে এসে কেউ সনদ চাইলে সেটি আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে স্বাক্ষর হয়ে ওয়ার্ড কার্যালয়ে সেই সনদ ফিরে যেতে কয়েক দিন লেগে যাচ্ছে।
সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, জন্ম-মৃত্যু ও নাগরিকত্ব সনদ পাওয়া এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ সেবা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে, যিনি ওয়ার্ডের লোকজনকে চেনেন না। এজন্য একটি জন্মসনদ নিতে ১০ দিনের বেশি লেগে যাচ্ছে।
ঠিকমতো সেবা না পাওয়ায় ওয়ার্ড সচিবের সঙ্গে সেবাপ্রার্থীদের বাগ্বিতণ্ডার ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি সেবাপ্রার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ডিএনসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ডের (পল্লবী) সচিব শামিউল ইসলাম শিশিরকে মারধর করেন। ওই ঘটনার পর শিশির ওয়ার্ড সচিবের দায়িত্ব পালনে অপারগতা জানান।
আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা বলছেন, নানা কারণে নাগরিকসেবা দিতে বিলম্ব হচ্ছে। বড় কারণ হলো, ওয়ার্ডের নাগরিকদের তথ্য যাচাই। কাজটি করতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। লোকবলের সংকটও রয়েছে। যাচাইকারী হিসেবে আগে কাউন্সিলররা স্বাক্ষর করতেন, এখন সেটি আঞ্চলিক নির্বাহীদের করতে হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই-বাছাই স্কুল-কলেজের শিক্ষক বা অন্য প্রতিষ্ঠানের গেজেটেড কর্মকর্তাদের দেওয়া যেত; কিন্তু সেটি আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের করতে হচ্ছে।’
ডিএনসিসির অঞ্চল-৫-এর নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বির আহমেদ বলেন, ‘নাগরিকদের যেসব সনদ দিতে হয়, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা বড় সমস্যা। কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেককে চিনি না। উত্তরাধিকার বা ওয়ারিশান সনদ তো খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। হয়তো ভাইবোন পাঁচজন; কিন্তু বলল তিনজন। না চিনলে যাচাই করব কীভাবে আর সনদ দেব কীভাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি সচিবের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করার। এতে কতটা স্বচ্ছ হচ্ছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ১২ জন কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিজের কাজ তো আছেই। সব মিলিয়ে ৩০ জনের কাজ একা করতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সেবা প্রাপ্তিতে বিলম্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক।’
মালিবাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মামুন রশিদ শুভ্রর বাসার নিচে ছিল এই ওয়ার্ডের অস্থায়ী কার্যালয়। অক্টোবরের শুরুতে কার্যালয়টি বাসাবো কমিউনিটি সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। শুধু এই ওয়ার্ডের কার্যালয় নয়, ডিএসসিসির ১, ৩, ৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সেবার কাজও এই কমিউনিটি সেন্টার থেকে চলছে। তবে এসব কার্যালয় স্থানান্তরের খবর জানেন না স্থানীয়রা। পুরোনো কার্যালয় বন্ধ থাকলেও সেখানে নতুন কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া হয়নি। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের পুরোনো কার্যালয়ে গিয়ে বেশ কয়েকজন সেবা গ্রহীতাকে পাওয়া যায়। বাবার মৃত্যু সনদ নিতে আসা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বাবা মারা গেছেন এক মাস আগে। তাঁর মৃত্যু সনদ নিতে পারছি না। সকালে এসে দেখি অফিস বন্ধ। নতুন অফিস কোথায়, সেই ঠিকানাও কেউ দিতে পারছে না।’ কিছু সময় পর সেখানে আসেন ওয়ার্ডের মশক সুপারভাইজার মো. তৌহিদ। তিনিও জানান, ওয়ার্ড কার্যালয়টি স্থানান্তরের খবর অনেকেই জানেন না।
ডিএসসিসির ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস ছিল ধানমন্ডির জিগাতলায়। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম বাবলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বিক্ষুব্ধ জনতা কার্যালয়টি পুড়িয়ে দেয়। এই ওয়ার্ডের কার্যালয় পরে মোহাম্মদপুরের সাতরাস্তায় স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু স্থানীয় অনেকে জানান, তারা এটি জানেন না। গুলিস্তান নগর ভবনে কথা হয় ধানমন্ডির বাসিন্দা আমজাদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মেয়েকে স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মসনদ নিতে হবে। কাউন্সিলর অফিস খুঁজে না পেয়ে নগর ভবনে চলে এসেছি। এখন বলছে মোহাম্মদপুরে যেতে।’
সম্প্রতি পুরান ঢাকার ৪৩ ও ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসে গিয়ে করপোরেশনের ওয়ার্ড সচিবদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন করপোরেশনের অন্য স্টাফরা, তবে সব বিভাগের প্রতিনিধিও নেই। ইসলামপুরের বাসিন্দা হাজি রহমত উল্লাহ বলেন, ‘ওয়ার্ড কার্যালয়টি গত ৫ আগস্টের পর বন্ধ ছিল। গত অক্টোবরের শুরুতে কার্যক্রম চালু হলেও সব সময় কর্মকর্তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।’ লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা জোনায়েদ বলেন, ‘বড় ভাই সাকেরুলের মৃত্যু সনদের জন্য দুই দিন ওয়ার্ড অফিসে গিয়েছি। প্রথম দিন গিয়ে কাউকে পাইনি। দ্বিতীয় দিন গিয়ে শুধু আবেদন জমা দিয়ে এসেছি। সপ্তাহ খানেক পরে ডেকেছে।’
ডিএসসিসির অঞ্চল-৪-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা আতাহার মিয়া সমকালকে বলেন, ‘আমার অঞ্চলের ১১টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাতটিতে সচিব নেই। অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। সব সেবা চালু রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলররা স্থানীয় হওয়ায় সবাইকে চিনতেন, সহজেই নাগরিক সনদ, মৃত্যু সনদ, উত্তরাধিকার সনদ দিতে পারতেন। আমরা সবাইকে চিনি না। তাই এসব সনদ দিতে সময় লাগছে।’
এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘কাউন্সিলর না থাকায় যেসব সমস্যা হচ্ছিল, সেগুলো সরকারকে জানানো হয়েছে। তারপরই আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের সেবা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে যেভাবে চলছে, সেভাবে চলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাজের চাপ নিতে হবে। এলাকার লোকদের চিনতে হবে।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিরা যাই হোক, তাদের লাগবে। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে জনপ্রতিনিধি নেই। তবে আপৎকালীন এই ব্যবস্থা কোনোভাবেই দীর্ঘায়িত করা ঠিক হবে না। এতে নাগরিক সুবিধা ব্যাপক মাত্রায় লঙ্ঘিত হবে।’
- বিষয় :
- সেবামুলক উদ্যোগ
- নাগরিক সেবা কেন্দ্র