যেখানে 'ভেজাল' জমি সেখানেই আনিস

আনিসুর রহমান
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০১৯ | ১৫:৩৯ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৯ | ১৫:৫৫
১২/৩/এ পূর্ব গোড়ানের তাহেদ আলী ঝিলের ৬০ শতাংশ জমি কিনেছিলেন সেই ১৯৭৪ সালে। তবে সিটি জরিপের কাগজপত্রে তার নামে জমি ওঠে মাত্র ৬ শতাংশ। বাকি ৫৪ শতাংশ ওঠে আরেকজনের নামে। এ নিয়ে রেকর্ড কারেকশন মামলা-পাল্টা মামলার জের ধরে বিষয়টি সমাধানের জন্য যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান সরকারের কাছে। দু'পক্ষের দ্বন্দ্বের সুযোগে পাঁচ-ছয় বিঘা আয়তনের পুরো ঝিলই দখল করে নেন আনিস।
এ কাজে কাউন্সিলর আনিসের সঙ্গে ছিলেন সাবেক কাউন্সিলর বাচ্চু শিকদারও। ঝিলটিকে পরে ভরাট করে বর্তমানে প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে। তাহেদ আলীর মৃত্যুর পর তার দুই ছেলেকে দুটি প্লট দেওয়ার মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেন আনিস। দুটি প্লট একসঙ্গে নিতে চান তারা। তবে তাদের দেওয়া হয় দুই প্রান্তের আড়াই কাঠার দুটি প্লট। তাহেদ আলীর ডাকনাম ছিল মাদানী। সেই সুবাদে ঝিলটিকে একসময় এলাকাবাসী চিনতেন মাদানী ঝিল নামে। এখন আর ওখানে ঝিলের চিহ্ন নেই। পরিবর্তে আছে শ'খানেক প্লট। সবাই জানেন প্লটগুলোর মালিক কাউন্সিলর আনিস।
গত কয়েকদিন গোড়ান এলাকায় (ডিএসসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ড) ঘুরে ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকায় মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকা ভেজাল জমি খুঁজে বেড়ান আনিস। এরপর সেটিকে একপক্ষের হয়ে দখল করেন। এ অবস্থায় কাউন্সিলরের কাছে বিষয়টি সালিশের জন্য এলে তিনি এগিয়ে আসেন মীমাংসা করতে। যে পক্ষ যত বেশি খুশি করতে পারে, তার পক্ষেই রায় দেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, আনিসের বর্তমান বাড়ি দক্ষিণ গোড়ানের ৪১১/এ নম্বর হোল্ডিংয়ের জমিও দখল করা। ওই জমিতে আটতলা অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করে বেশির ভাগ ফ্ল্যাট বিক্রিও করা হয়েছে। পূর্ব গোড়ান ৮ নম্বর গলির মাথায় শাহি মসজিদের সামনে আরেকটি জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে আনিসের বিরুদ্ধে।
শাহি মসজিদের সামনের ওই চার কাঠার প্লটটির মালিক ছিলেন তিলপাপাড়ার শাহিনা বেগম। তিনি সেটি বিক্রি করেন আমির হোসেন পাটোয়ারীর কাছে। দখল করার পর জমিটি সব সময় পাহারা দেওয়ার জন্য লোকজনও রেখেছেন আনিস। দক্ষিণ বনশ্রীর শাজাহান সাহেবের জমিও একইভাবে দখল করেন আনিস। পরে মীমাংসার নামে আদায় করেন মোটা টাকা। আনিসের হয়ে এসব জমিজমার দিক তদারকি করেন আনিসের ভাই মাহবুব ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব। একই নাম হওয়ায় এলাকায় তারা পরিচিত দুই মিতা হিসেবে।
আনিস যখন বের হন, তখন তার সামনে-পেছনে থাকে অন্তত অর্ধশত মোটরবাইক। প্রতিদিন তার এই মহড়ায় এলাকাবাসী সব সময় আনিস-আতঙ্কে থাকেন। এলাকায় কেউ ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করতে গেলেই তার লোকজন গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। একটি ফ্ল্যাট বা দুটি গ্যারেজ, তার ছেলেপুলেদের ইট-বালু-রড-সিমেন্ট সাপ্লাইয়ের কাজ দেওয়ার দাবি জানান। এসব ছেলেকে নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের কাজ দিয়ে ডেভেলপাররা পড়েন বিপদে। হয়তো ১০০ ঘনফুট বালু দিয়ে তারা ৩০০ ঘনফুট বালু দেওয়ার কথা বলে। এ রকম অনেক রকম ঝামেলা করে তারা। ভুক্তভোগী বিচার চাইলে আনিসের বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, 'তাহলে কি আমাদের কাজ করেও খেতে দেবেন না আপনারা?'
গোড়ানের ৩১ নম্বর রোডে গোড়ান আদর্শ স্কুলের পাঁচ কাঠা জায়গা দখল করে সেখানে গড়ে তোলা ক্লাবে আনিসের ছত্রছায়ায় চলছে জুয়া খেলা ও মাদক সেবনসহ নানা অপকর্ম। 'টর্চার সেল' নামেও এলাকায় পরিচিত এটি। কারণ আনিসের কথার অবাধ্য হলে তাকে সেখানে নিয়ে টর্চার করা হয়। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই টর্চার সেলে বনশ্রী বাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি হানিফকে নিয়ে অত্যাচার করা হয়। কারণ ময়লা-আবর্জনার ব্যবস্থাপনা আগে বাড়ির মালিকদের উদ্যোগেই হতো। সেটা আনিসের লোকজন করতে চাওয়ায় তিনি অসম্মতি জানিয়েছিলেন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে আনিসের লোকজন। এ জন্য প্রতি ফ্ল্যাট মালিককে এখন দিতে হয় ৫০ টাকার বদলে ১৫০ টাকা।
সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে রিমান্ডে নিলে তিনিও আনিস সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। তিনি বলেন, খিলগাঁও-গোড়ান এলাকায় মাদকের কারবার, অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকা নিয়ন্ত্রণ করেন আনিস। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো পরিচালনায়ও জড়িত তিনি।
ভেজালের জমি আনিসের কাছে আশীর্বাদ। ত্রুটিযুক্ত নথিপত্র ও বিরোধপূর্ণ এসব জমি নানা কৌশলে দখলে নিতে তার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। এই বাহিনী দিয়ে উত্তর গোড়ান, দক্ষিণ গোড়ান, পূর্ব গোড়ান, দক্ষিণ বনশ্রীসহ আশপাশ এলাকায় বেশ কয়েকটি জমি ও বাড়ি দখলে নিয়ে বিক্রিও করেছেন তিনি। এলাকায় মাদক কারবার ও অবৈধ অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণসহ সন্ত্রাসী কর্মকাে র অভিযোগও পাওয়া গেছে আনিস ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এখানে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের রানা। তাদের বিরুদ্ধে মাদকসহ একাধিক মামলা রয়েছে। মাদকের মামলায় রানা বর্তমানে জেলে এবং সাইফুল বর্তমানে জামিনে রয়েছে।
দক্ষিণ বনশ্রীর এল ব্লকের ১০০ নম্বর সড়কের ৩৫ নম্বর বাড়িটির জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে আনিসের বিরুদ্ধে। তার নিজস্ব ক্যাডার মতিন, কাঠ ফারুক ও শফিকের মাধ্যমে তিনি জমিটি দখল করেন। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, আবুল খায়ের মোল্লা নামের এক ব্যক্তিকে মালিক সাজিয়ে প্রবাসী এক ব্যক্তির কেনা জমিটি তিনি দখল করেন। জমিটিতে এখন সাততলা ভবন উঠছে। খায়ের মোল্লার ছেলে হাসিনুল হাসান একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। গোড়ান হাওয়াই গলিতে একটি নির্মাণাধীন ভবনের কয়েকটি ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগও রয়েছে আনিসের বিরুদ্ধে।
গোড়ান এলাকার প্রায় প্রতিটি রাস্তাই ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা। একই অবস্থা দক্ষিণ বনশ্রী, তিতাস রোডসহ আশপাশের সব সড়কের। এসব নিয়ে অনেক অভিযোগ করেও প্রতিকার মেলেনি। গোড়ান আদর্শবাগ, নবাবীমোড়, দক্ষিণ গোড়ান ও পূর্ব গোড়ান, নূরবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় পানির সমস্যা দীর্ঘদিনের। এসব সমাধানের কথা বলে আনিসের সহযোগী তাহসীন মোস্তাফিজুর রহমান, হাবীব, মোস্তফা, রাজন, রাব্বী ও সোহেলসহ কয়েকজন দফায় দফায় বিভিন্ন বাড়ি থেকে টাকা তোলেন। তবে পানি সমস্যার সমাধান হয়নি। এসব চাঁদা আদায়কারীর বিরুদ্ধে আনিসের অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগও রয়েছে।
২০১৫ সালে মেয়র নির্বাচনের সময় গোড়ান টেম্পোস্ট্যান্ড এলাকায় ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি কাউন্সিলর প্রার্থী হাবিবা চৌধুরীর মিছিলে গুলি করে আনিসের ক্যাডার বাহিনী। এতে ওয়ার্ড বিএনপির ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাজমুল হুদা ওরফে আরজু গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া ২০১৫ সালে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে বিরোধের জেরে সেগুনবাগিচায় ছাত্রলীগ নেতা লিয়াকত সিকদারকে লক্ষ্য করে আনিসের নেতৃত্বে গুলি ছোড়া হয়। তার গাড়িও ভাংচুর করা হয়।
আনিসের উত্থান ম্যাজিকের মতো। ১৯৯৯ সালে ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ২০০২ সালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ২০১০ সালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি হন। ২০১৫ সালে তিনি কাউন্সিলর হন। এখন তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছসেবক লীগের সভাপতি প্রার্থী। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো শক্ত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সাধারণ পরিবারের সন্তান হলেও এখন তিনি বিত্তবৈভবেরও মালিক। কিন্তু তার তেমন কোনো ব্যবসা নেই।
কাউন্সিলরের বক্তব্য: এসব প্রসঙ্গে আনিসুর রহমান বলেন, এলাকার তিনজন লোক আছে, যারা এসব কথা তার বিরুদ্ধে ছড়াচ্ছে। যে বাসায় তিনি থাকেন, সেখানে তাদের তিন ভাইয়ের তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এগুলোতে তারা তিন ভাই থাকেন। এগুলো টাকা দিয়ে কেনা। দখল করা নয়। মাদানী ঝিলও তিনি দখল করেননি। যাদের জায়গা তারাই বলেছিল ভরাট করে দিতে। লোকজন দিয়ে তিনি সেটা ভরাট করে দিয়েছেন। আর প্লট তৈরি করেছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রুবেল। ওই জায়গা কোবা হাউজিং সোসাইটির। এর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
কাউন্সিলর জানান, যাদের বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে, তিনি তাদের বিরুদ্ধে। তারা স্থানীয় এমপি সাবের হোসেন চৌধুরীর অনুসারী। তাদের মধ্যে একজনের অফিস উদ্বোধন করেছিলেন এমপি সাহেব। এ ছাড়া যখনই তারা মাদক নিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে, তখন এমপি সাহেব তাদের ছাড়ানোর জন্য তদবির করেন।
কাউন্সিলর আনিসুর বলেন, তিনি কোনো অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি পদে তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেভাবে মিডিয়া তার পেছনে লেগেছে, আর তিনি প্রার্থী হবেন না। তিনি জানান, তার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। বর্তমানে তিনি রাজনীতির পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করেন। তার বাড়িতেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস।