তিন বছরে নিহত ১৩৭
হানিফ ফ্লাইওভার যেন দুর্ঘটনার 'হটস্পট'

রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরে চলছে গাড়ি নিয়ে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। হেঁটে যাতায়াতের ব্যবস্থা না থাকলেও পারাপারের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে মানুষ। মঙ্গলবার তোলা ছবি মাহবুব হোসেন নবীন
আতাউর রহমান
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২৩:১৮
রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের (উড়াল সড়ক) টোল প্লাজার সামনে গত ৮ জানুয়ারি মেঘলা পরিবহনের একটি বাসের চাপায় দুই পথচারীর মৃত্যু হয়। ওই বাসের চালক রাকিব শরীফ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর স্বীকারোক্তি দেন, বেশি ট্রিপ পেতে বেপরোয়া গতিতে তিনি বাসটি চালাচ্ছিলেন। ওই দিনের ঘটনা ছাড়াও দেশের বৃহত্তর এই উড়াল সড়কে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। হতাহতের পর এসব দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেলেও ছোটখাটো দুর্ঘটনার তথ্য থাকে আড়ালেই।
উড়াল সড়কটির ওপর এই দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহন চালক, উড়াল সড়কের নিরাপত্তাকর্মী আর নিয়মিত যাতায়াতকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকিংয়ের কারণে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া শহরতলিতে চলাচলরত বেশিরভাগ বাসের ব্রেক সমস্যাসহ ফিটনেস না থাকায় সেগুলো দুর্ঘটনায় পড়ছে। মোটরসাইকেল চালকরা লেন ভায়োলেন্সের কারণে নিয়মিত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। উড়াল সড়কের সম্প্রসারণ সংযোগে 'এক্সপ্যানশন জয়েন্টে' অতিরিক্ত ফাঁকা থাকায় মোটরসাইকেলের চাকা আটকেও দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা। উড়াল সড়কের ওপর দিয়ে পথচারীদের হেঁটে যাতায়াতের ব্যবস্থা না থাকলেও তাদের অবাধ হাঁটা-চলাকেও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
এই উড়াল সড়কে গত এক মাসে বড় অন্তত তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮ জানুয়ারি মেঘলা পরিবহনের বাসের ধাক্কায় দুই পথচারী নিহত হন। একই ঘটনায় আহত হন আরও অন্তত ১২ জন। সেদিন বাসটি গুলিস্তান অংশ দিয়ে নামার সময় পথচারীদের ওপর তুলে দেওয়া হয়েছিল। এর আগে ৩০ ডিসেম্বর ওই অংশ দিয়েই ফ্লাইওভারে উঠতে গিয়ে শ্রাবণ পরিবহনের ধাক্কায় পুলিশের এক কনস্টেবল আহত হন। সেই বাসটি সেখান থেকে সরাতে গিয়ে সেটির ধাক্কায় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীসহ নিহত হন দু'জন। ২৬ জানুয়ারি ওয়ারীর রাজধানী সুপারমার্কেটের ওপরে মেঘালয় লাক্সারি পরিবহনের ধাক্কায় দুই অটোরিকশার অন্তত পাঁচ যাত্রী আহত হন। যদিও এই সময়ের মধ্যে রাজধানীর অন্যান্য উড়াল সড়কে এ ধরনের দুর্ঘটনা নেই।
১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তান ও চানখাঁরপুল থেকে শনিরআখড়া ও পোস্তগোলা পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। চার লেনের ফ্লাইওভারে উঠতে ছয়টি এবং বের হতে সাতটি পথ রয়েছে। দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঘটছে যাত্রাবাড়ী ও ওয়ারী থানা এলাকার মধ্যে। ওই দুটি থানা ও ট্রাফিক পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে এই উড়াল সড়কে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ১৩৭ জন। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। এর আগের দুই বছরে উড়াল সড়কটির বিভিন্ন অংশে দুর্ঘটনায় ২০২০ সালে ৫৭ জন এবং ২০১৯ সালে ৩৩ জন নিহত হন। দুর্ঘটনার 'হটস্পট' হয়ে উঠেছে উড়াল সড়কটি।
হানিফ ফ্লাইওভার ট্রাফিক পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত সার্জেন্ট মো. আরেফিন আকন্দ ফ্লাইওভারটিতে বারবার গাড়ি দুর্ঘটনার কারণগুলো তুলে ধরে সমকালকে বলেন, ফ্লাইওভারে উঠার পর গাড়িগুলোর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। চালকরা যে যেভাবে পারেন- লাইন, লেন অমান্য করে চালান। ওভারটেকিং করেন ইচ্ছামতো, ফাঁকা পেলেই বেপরোয়া গতিতে চালানো শুরু করেন। ওপরের সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করার মতো ব্যবস্থা নেই। এ জন্য তারা তা নিয়ন্ত্রণও করতে পারেন না। কেবল দুর্ঘটনার পরই তারা উড়াল সড়কের ওপরে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া থাকেন মোটরসাইকেলের চালকরা। তারা বারবার লেন পরিবর্তন করেন। এতে দ্রুতগতির বাসগুলোর সঙ্গে ধাক্কা লাগে। তা ছাড়া উড়াল সড়কের কিছু অংশে সম্প্রসারণ সংযোগে এক্সপানশন জয়েন্টের ফাঁকায় দ্রুতগতির মোটরসাইকেলের চাকা পড়লে আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। তখনও দুর্ঘটনা ঘটে।
হানিফ ফ্লাইওভারের গুলিস্তান অংশ দিয়ে নামা ও টিকাটুলী থেকে উঠার অংশটি ওয়ারী থানা এলাকায় পড়েছে। ওই থানার ওসি কবির হোসেন হাওলাদার সমকালকে বলেন, গাড়িগুলো টোল প্লাজায় আটকে থাকে। তখন শহরতলির বাসের যাত্রীরা বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেন। টোল দেওয়ার পর গাড়িগুলো দ্রুতগতিতে নিচে নামতে গিয়ে পথচারীদের ওপর উঠিয়ে দেয়। অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও পথচারীদের ওপর উঠে যায় বাস। যদিও টোল প্লাজার পর বা পুরো উড়াল সড়কের কোথায়ও হাঁটার নির্ধারিত জায়গা নেই। এর পরও পথচারীরা ওঠা-নামার পথে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছেন।
গত শুক্রবার ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদ থেকে টিকাটুলী হয়ে গুলিস্তান নামার সময়ে দেখা যায়, অনেক বাস উড়াল সড়কের ওপরে থামিয়ে যাত্রী ওঠানো ও নামানো হচ্ছে। গুলিস্তান টোল প্লাজার আগে উড়াল সড়কের একটি অংশ চলে গেছে পলাশীর দিকে। ওই রুটে চলাচলরত ঠিকানা ও মৌমিতা পরিবহনের বিভিন্ন বাস থেকে উড়াল সড়কের ওপরেই যাত্রী নামতে দেখা যায়। পরে তাদের অন্তত এক কিলোমিটার হেঁটে গুলিস্তান দিয়ে নামতে হয়।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিরাপত্তা সুপারভাইজার মো. শাহিন শুক্রবার দুপুরে সমকালকে বলেন, তারা সবসময় গাড়ি ও যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তারা যাতে নিয়ম মেনে চলাচল করেন, সে চেষ্টা তাদের নিরাপত্তাকর্মীরা করে থাকেন। এর পরও দেখা যায়, অনেক পরিবহনের বাস নানা দুর্ঘটনায় পড়ছে। বাসের চালকরা শুধু লোকজনের ওপরই উঠিয়ে দিচ্ছেন না, নামার সময়ে উড়াল সড়কের নানা আইল্যান্ড বা বেষ্টনীর সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে ক্ষতি করছেন। ফিটনেস না থাকায় এবং বেপরোয়া গতিতে চলতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় সেগুলো দুর্ঘটনায় পড়ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান সমকালকে বলেন, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হচ্ছে বেশি। এর বড় কারণ বেপরোয়া গতি। চালকরা শহরের সড়কগুলোতে নিজেদের মতো করে মোটরসাইকেল চালাতে না পেরে উড়াল সড়ক ফাঁকা পেয়েই গতি বাড়িয়ে দেন। তা ছাড়া উড়াল সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ না থাকাও এই দুর্ঘটনার একটি কারণ। তিনি আরও বলেন, বাসের চালকরাও বেপরোয়া থাকেন। তারা পাল্লা দিতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। বাসগুলোরও ফিটনেস নেই। ফ্লাইওভারে যান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থাও নেই। এ ছাড়া পথচারীরাও সচেতন নন। এসব কারণে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে।
- বিষয় :
- হানিফ ফ্লাইওভার
- দুর্ঘটনা
- উড়াল সড়ক