ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

‘যুদ্ধবিরোধী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এক ইংরেজ মায়ের চিঠি

‘যুদ্ধবিরোধী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এক ইংরেজ মায়ের চিঠি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুভাষ সিংহ রায় 

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৪ | ২২:৩৯ | আপডেট: ০৭ মে ২০২৪ | ২২:৩৯

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কবি খ্যাতি ও গীতাঞ্জলি দেশে দেশে পৌঁছে গিয়েছিল। সারা বিশ্বের, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের মানুষ তাঁকে চিনেছিলেন মূলত গীতাঞ্জলির কবি রূপে। আমেরিকাবাসী কিন্তু তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার ঘোষণার বেশ আগে। যদিও সুদূর ভারতের এক অজানা অতীন্দ্রিয়বাদী কবি রূপে আমেরিকার সাহিত্য জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম আত্মপ্রকাশ, তবুও আশ্চর্যের বিষয় আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শুরু থেকেই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কবিতার আসরে নয়, সাহিত্যের আলোচনা সভাতেও নয়; ভারতীয় দর্শন বিশেষত উপনিষদের উপর বক্তৃতা করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় মহলে তাঁকে বলা হতো প্রাচ্যের এক বিদগ্ধ দার্শনিক-কবি। সাল তখন ১৯১২।

১৯১২ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত ভ্রমণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পদার্পণ করেন। সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। রথীন্দ্রনাথ ইলিনয়  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন। জোড়া শহর শ্যামপেন-আর্বানাতে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল আর্বানায় নিরিবিলিতে কিছুদিন কর্মক্লান্ত অবসর কাটাবেন। কিন্তু দৈনিক কাগজ ‘দ্য ডেইলি ইলিনি’ তাঁর আগমনের সম্ভাবনার কথা বহু আগেই প্রচার করে দিয়েছিল। ১ অক্টোবর ১৯১২ কাগজে বড় হরফে লেখা হয়েছিল- ‘পোয়েট টু ভিজিট ইউনিভার্সিটি: ফেমাস ইন্ডিয়ান রাইটার কামিং সুন’।

ইউনিটারিয়ান চার্চে রবীন্দ্রনাথের প্রথম বক্তৃতা হয়েছিল ১০ নভেম্বর ১৯১২। বক্তৃতাটি বহুল প্রশংসিত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে আরও তিনটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘ইমপারফেক্ট এনকাউন্টার: লেটারস অব উইলিয়াম রোথেনস্টেইন অ্যান্ড রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর’ গ্রন্থের সম্পাদিকা মেরি লাগোর দেওয়া তথ্যে আর্বানার চার্চে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার বিষয়বস্তুর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।

১৯৩৭ সালে ভারতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে গঠন হলো ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধবিরোধী সঙ্ঘ। এই সংগঠনে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের লেখক, শিল্পী, রাজনীতিবিদরা যুক্ত হলেন। তাদের মধ্যে মুন্সী প্রেমচাঁদ, নন্দলাল বসু, জওহরলাল নেহেরু, তুষারকান্তি ঘোষ, এস এ ডাঙ্গে, জয়প্রকাশ নারায়ন, শিবনাথ ব্যানার্জী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

ফ্যাসিবাদবিরোধী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নাৎসিদের সাথে যুদ্ধে যেদিন প্যারির পতন হয় সেদিন স্বাধীন প্যারি বেতার কেন্দ্রে সবশেষ যে নাটকটি পরিবেশিত হয় তা হলো আন্দ্রে জিও অনুদিত রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। নাটকের শেষ পংক্তিতে ছিল অমলকে বলো সুধা তাকে ভোলে নি। একসঙ্গে তারা একটি পংক্তি যোগ করে ‘স্বাধীনতাকে বলো প্যারি তাকে ভোলে নি’। পোলান্ডের বন্দী শিবিরে এক বন্দী শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের অনুদিত কবিতা শিখিয়েছিলেন কিশোর বন্দীদের। তারা তা বলে মাথা উঁচু করেই কোন ভয় না পেয়ে গ্যাস চেম্বারে ঢুকেছিলেন। আর্জেন্টিনার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। ওই দেশে অজানা সৈনিকদের স্মৃতিতে নির্মিত বেদীতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পা অনুদিত ‘ও আলোর দেশের যাত্রী’ খোদাই করা আছে।

আমি ভিয়েতনামের তরুণ-তরুণীদের কাছে শুনেছি তারা তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে কিভাবে প্রেরণা পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলি থেকে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কেমন করে রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে রেখেছেন তা দেখার অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই আছে। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী বিপ্লবীরা, যোদ্ধারা বিভিন্ন কারাগারে, আন্দামানের সেলুলার জেলে বা ফাঁসির মঞ্চে জীবন দেওয়ার সময়েও কীভাবে রবীন্দ্রনাথ তাদের পাশে, তা নিয়েও বহু লেখা আছে। আবার জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ড, হিজলী জেলে গুলি চালানোর প্রতিবাদে বা বঙ্গভঙ্গের রদ করার আন্দোলনে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

পৃথিবীর অন্যতম যুদ্ধ-বিরোধী কবি উইলফ্রেড ওয়েনকে (১৮ মার্চ ১৮৯৩-৪ নভেম্বর, ১৯১৮) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রণাঙ্গনে যেতে হয়েছিল বাধ্য হয়েই। অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা এই যে, তাঁকে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে যুদ্ধসমাপ্তির মাত্র সাতদিন আগে নিহত হয়েছিল। যুদ্ধে নিহত সেই মহান ইংরেজ কবির পকেটে পাওয়া গিয়েছিল একটি ডায়েরি, লেখা ছিল ১৯১২ সালে প্রকাশিত ‘গীতাঞ্জলি সংস অফারিংস’ গ্রন্থের ৯৬ সংখ্যক কবিতাটি: ‘হোয়েন আই গো ফ্রম হেন্স/ লেট দিজ বি মাই পারটিং ওয়ার্ক/ দ্যাট হোয়াট আই হ্যাভ সীন ইজ আনসারপাসেবল’। নিচে লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর’।

(অর্থাৎ ১৯১০ সালে ১৪ আগস্ট বাংলা’ গীতাঞ্জলী’র ১৫৭ সংখ্যক কবিতা ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই/যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’)
উইলফ্রিড ওয়েনের মা সুজান এইচ. ওয়েন জানতেন তাঁর ছেলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধার কথা। তিনি রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, রথীন্দ্রনাথকৃত সে চিঠির বাংলা তর্জমা লিপিবদ্ধ হয়েছে তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে:

শ্রজবেরি
১ আগস্ট ১৯২০

শ্রদ্ধেয় স্যার রবীন্দ্রনাথ,
যেদিন শুনেছি আপনি লন্ডনে এসেছেন, সেদিন থেকে রোজই ভাবছি আপনাকে চিঠি লিখি। আর আপনাকে আমার মনের কথাটুকু জানাবার জন্য সেই চিঠি লিখছি। এ চিঠি আপনার হাতে গিয়ে পৌঁছবে কি না জানি না; কারণ আপনার ঠিকানা আমার জানা নেই। তবু আমার মনে হচ্ছে লেফাফার উপর আপনার নামটুকুই যথেষ্ট। আজ থেকে দু-বছর আগে আমার অতি স্নেহের বড়ো ছেলে যুদ্ধে যোগ দেবার জন্যে ফ্রান্স পাড়ি দিল। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। যাবার আগে আমার কাছে বিদায় নিতে এল। আমরা দুজনেই তাকিয়ে আছি ফ্রান্সের দিকে। মাঝখানে সমুদ্রের জল রৌদ্রে যেন ঝলমল করছে। আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় আমাদের বুক ভেঙে যাচ্ছে। আমার কবি-ছেলে তখন আপনা মনে আপনার লেখা কবিতার সেই আশ্চর্য ছত্রগুলি আউড়ে চলেছে: ‘যাবার দিনে এই কথাটি/ বলে যেন যাই-/ যা দেখেছি, যা পেয়েছি/ তুলনা তার নাই’।

তার পকেট-বই যখন আমার কাছে ফিরে এল, দেখি তার নিজের হাতে এই কটি কথা লিখে তার নীচে আপনার নাম লিখে রেখেছে। যদি কিছু মনে না করেন, আমায় কি জানাবেন কোন বইয়ে সম্পূর্ণ কবিতাটি পাওয়া যাবে?

এই পোড়া যুদ্ধ থামবার এক হপ্তা আগে আমার বক্ষের ধন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিল। যেদিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হল, সেদিন এই নিদারুণ খবর এসে পৌঁছল আমাদের কাছে। আর কিছুদিন পরেই আমার ছেলের একটি ছোটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবে। এ বইয়ে থাকবে যুদ্ধের বিষয়ে লেখা তার কবিতা। দেশের অধিকাংশ লোক নিশ্চিন্ত আরামে নিরাপদে দেশে বসে আছে, যুদ্ধক্ষেত্রে যারা অশেষ দুঃখকষ্ট বরণ করছে, এমন-কি, প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে, তাদের জন্য কোনো মমতা বা অনুভূতি নেই-এ কথা ভেবে বাছা আমার ভারি মনোবেদনা অনুভব করত। যুদ্ধে যে কোনো পক্ষেরই কোনো লাভ নেই- এ বিষয়ে তার সংশয় মাত্র ছিল না। কিন্তু নিজের দুঃখকষ্ট সম্বন্ধে সে একটি কথাও বলেনি তার কবিতায়। যারা তাকে ভালোবাসত একমাত্র তারাই বুঝবে-কী গভীর দুঃখ ছিল তার মনের মধ্যে। তা না হলে এরকম কবিতা সে লিখতে পারত না। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র পঁচিশ বছর। সে ছিল সৌন্দর্যের উপাসক-তার নিজের জীবন ছিল সুন্দর, কল্যাণময়।

আমি অভিযোগ করব না, ভগবান তাকে যখন টেনে নিলেন, ভালোবেসেই নিয়ে গেছেন। আমার মায়ের প্রাণ, আমি নিয়ত তাঁর কাছে কত প্রার্থনাই করেছি। তিনি প্রেমময়, তিনি যদি ভালো বুঝতেন তা হলে তো মায়ের কোলেই সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন। সুতরাং আমি নতমস্তকেই তাঁর বিধান মেনে নিয়েছি। যতদিন এ জগতে আছি, কোনো অভিযোগ না করে নীরবে কাটিয়ে যাব। আমাদের ত্রাণ করার জন্য যিনি মানুষের রূপ ধরে এসেছিলেন, তিনি আমাদের জন্য এক অমৃতলোক রচনা করে রেখেছেন। সেইখানে আমার উইলফ্রিডের সঙ্গে আমি আবার মিলিত হব।

আমি যখন চিঠি লিখতে শুরু করি তখন ভাবিনি এত কথা লিখব, চিঠি বড়ো হয়ে গেল বলে আমায় মার্জনা করবেন। আপনি যদি আমার ছেলের কবিতার বইখানি পড়েন, ভারি অনুগৃহীত বোধ করব। চ্যাটো অ্যান্ড উইন্‌ডাস শরৎকালের মধ্যেই বইখানি বের করবে। যদি অনুমতি দেন আমি একখানি বই আপনাকে পাঠিয়ে দেব।

বিষন্ন মনের আঁধারে আলোর দিশারি মনোবিদ রবীন্দ্রনাথ, আমার গভীর শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।

ইতি,
উইলফ্রিড ওয়েনের মা 
সুজান এইচ. ওয়েন।

এক পুত্রহারা মাতৃহৃদয় সান্ত্বনার সন্ধান খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণার দিন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ক্লেমাঁসোও স্মরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি কঁতেস দ্যা নোয়াইয়ের মুখে ‘গীতাঞ্জলি’র কিছু অংশ শুনে স্বস্তি অনুভব করেছিলেন। এভাবেই সারাজীবন ধরে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন মানুষের নানান মানসিক উৎকণ্ঠা, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব-এমন কী শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্ত হতে সহায়ক হয়েছেন, প্রত্যক্ষভাবে অথবা চিঠিপত্রের মাধ্যমে।

সুভাষ সিংহ রায়: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন

×