ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভিটামিন ডি

মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভিটামিন ডি

.

লে. কর্লেন ডা. নাসির উদ্দিন আহমদ

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ২২:২৩

শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা ভালো, অনেকেই মা হতে পারছেন না ভিটামিন ডি’র অভাবে। এমন করে কথাটা বলে ফেলার ভিত্তি হলো, হাল জামানার এক গবেষণায় শতকরা ৯৩ ভাগ অনুর্বর রমণীদের মাঝে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি পেয়েছে। মায়ের জরায়ুতে যখন নতুন জীবন নেমে আসে, তখন এই ভিটামিনের ঘাটতি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয় প্রি-একলামশিয়া, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস। এটি বাড়িয়ে দেয় সিজারিয়ান অপারেশনের হার। আর আগন্তুক অতিথি যখন বেড়ে উঠতে থাকে জরায়ুর ভেতর, তখন তার বৃদ্ধি হয় ব্যাহত, বাচ্চা হয় খর্বাকৃতির, হাড় গড়ে ওঠে উনপাঁজুরে। জন্ম নেওয়া শিশুটির হতে পারে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি, হতে পারে খিঁচুনি। আর টাইপ-১ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা তো রয়েছেই। কিশোরীরাই তো একদিন মা হবে। মজবুত হাড়-মাংস না হলে তো একসময় বিশাল ধকল পোহানোর উপযোগী থাকে না তারা। মাংস আর হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় এই ভিটামিনের ভূমিকা অবিদিত। এর অভাবে হাড় নরম হয়ে বেঁকে যায়। যাকে বলা হয় রিকেটস। কিছু রোগ এমন আছে, যেসব রোগে শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষ ধ্বংস করতে থাকে নিজস্ব কোষকে যেমন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, মাল্টিপলস ক্লেরোসিস। এসব রোগে দেখা যায় উদ্দীপ্ত লড়াকু কোষ ধ্বংস করতে থাকে অস্থিসন্ধির কোষ কিংবা মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ কোষ। এসব ব্যাধিকে বলা হয়, অটো ইমিউন ব্যাধি। আর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এ রোগগুলো নারীদের হয়ে থাকে বেশি। 

ভিটামিন ডি অটো ইমিউন রোগ প্রতিরোধে এভাবে অংশ নেয় এবং নারী স্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে পারে এসব ব্যাধির কবল থেকে। ভিটামিন ডি ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা নেয়। বিশেষত স্তন, প্রোস্টেট, জরায়ু, যোনি এবং বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে এর ভূমিকা অনন্য। শতকরা ৭০ ভাগ স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত নারী ভিটামিন ডি’র ঘাটতির শিকার। দৈনিক ২ হাজার ইউনিট ভিটামিন ডি গ্রহণ করলে স্তন ক্যান্সারের হার শতকরা ৫০ ভাগ কমানো সম্ভব। অনেক রমণী যৌন কর্মকাণ্ডে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন না, দেহের যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস, অনিচ্ছা, প্রচণ্ড উত্তেজনার মুহূর্তকে উপলব্ধি না করা এবং যৌনকর্মের পর ব্যথা অনুভব করার উপসর্গ অনেকের মাঝে আছে। এই উপসর্গগুলো যদি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয় তবে তাকে বলা যেতে পারে ফাংশনাল সেক্সুয়াল ডিসঅর্ডার। 

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এর পেছনে ভিটামিন ডি’র ভূমিকা রয়েছে। যদি ডিম্বাশয়ে অনেকগুলো সিস্ট থাকে এবং এর সঙ্গে আরও কিছু প্রাণ রাসায়নিক জটিলতা বিদ্যমান থাকে তাকে বলা হয় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। সঙ্গে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বন্ধ্যত্ব সম্মিলিতভাবে অবস্থান করতে পারে। এমতাবস্থায় ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যায় ক্ষেত্রবিশেষ হরমোন জটিলতায় নারী দেহে আসতে থাকে অবাঞ্ছিত লোম। আর বলাই বাহুল্য, এই রোগে আক্রান্ত হলে নারীদের রজঃস্রাবে থাকে অনিয়ম। এ রোগের সঙ্গে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি যোগসূত্রতা খুঁজে পেয়েছেন হাল জামানার গবেষকরা। সূর্য যখন তার তেজ হারাতে থাকে বিশেষত শীতের মৌসুমে, তখন অনেকেই বিষণ্ণতায় ভোগেন। তাদের আচার-আচরণে আসে পরিবর্তন। মানসিকভাবে তারা মুষড়ে পড়েন। ক্লান্তি আর অবসাদ ভর করে তাদের ওপর। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ক্লান্তি। এটাকে বলে সিজনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার। দেখা যায়, শীতের নিষ্প্রভ আলোতে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি হয় আর এটি এই রোগের জন্য দায়ী। ভিটামিন ডি আর ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার মানসিক চাপ যেমন অশ্রু ভারাক্রান্ততা, মানসিক অস্থিরতা, খিটখিটে ভাব ইত্যাদি কমিয়ে দেয়। ভিটামিন ডি ওজন কমাতে সাহায্য করে। ক্ষেত্রবিশেষে চুল পড়া বন্ধ করে। ইনফেকশনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এটি মস্তিষ্কের পুষ্টি জোগায়। ভিটামিন ডি’র অপ্রতুলতায় আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার পর দেখা গেছে এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। যখন সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা– এমন এক অবস্থা বিরাজমান, তখন চিকিৎসকরা চিন্তায় পড়ে যান। পেশিতে পেশিতে ব্যথা কিন্তু কোনো যুতসই কারণ নেই। এমন সব নারীর মাঝে গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৯৩ জনেরই ভিটামিন ঘাটতি। এটি পেশিশক্তি সংহত করে। বাড়িয়ে দেয় পেশিশক্তি। যার ফলে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করে। বয়স্ক নারীদের পড়ে গিয়ে হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। রজঃনিষ্কৃতির পর নারীদের ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন থেকেই হাড় ক্ষয় হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তখন এসব নারীর জন্য সরবরাহ করতে হয় অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি আর ক্যালসিয়াম। অস্থিক্ষয় রোধের জন্য শুরু থেকেই যদি পর্যাপ্ত পুষ্টি জোগান দেওয়া না যায়, তবে একসময় হাড়ে চির ধরে। অল্প আঘাতেই ভেঙে যায় হাড়। এভাবে ভিটামিন ডি প্রমীলা স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
 [মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, সিএমএইচ, ঢাকা]
 

আরও পড়ুন

×