ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

নদীর নামে দেবী বহমান এই দেশে

নদীর নামে দেবী বহমান এই দেশে

শেখ রোকন

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৩ | ০৭:৫৪

বাংলাদেশে দুর্গোৎসব মানে নদনদীরও উৎসব। পূজামণ্ডপে যে ছয় দেব-দেবী ও এক অসুরের প্রতিমা রয়েছে, প্রত্যেকের নামাঙ্কিত নদী রয়েছে এ দেশে। যেমন দুর্গার আরেক নাম গৌরী। গৌরী হচ্ছে গড়াই নদীর প্রাচীন নাম। কুষ্টিয়া অঞ্চলে এ নদী গঙ্গা থেকে উৎপন্ন হয়ে পরবর্তী সময়ে মধুমতী, কালীগঙ্গা, কচা, বলেশ্বর, হরিণঘাটা নামে প্রবাহিত হয়েছে। পুরাণমতে দুর্গা হিমালয়ের কন্যা, গঙ্গা নদীর বোন। পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে মিল রেখেই যেন ভূগোলের গঙ্গা ও গৌরী সহোদরা।

আরেক প্রতিমা সরস্বতী বৈদিক নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদের ‘ত্রিবেণি’ বা তিন নদীর সংযোগস্থলে এই নদী যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গে মিলেছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে রয়েছে আরেক ত্রিবেণি। তিন নদী যুক্ত হয়েছে বলে এলাহাবাদের ত্রিবেণি ‘যুক্তবেণি’। আর পশ্চিমবঙ্গের ত্রিবেণিতে এসে তিন নদী বিযুক্ত হয়েছে বলে এর নাম ‘মুক্তবেণি’। কল্যাণী সেতু পার হয়ে খানিকটা সামনেই সেই মুক্তবেণিতে গিয়েছিলাম ২০১৫ সালে। মাঝনদীতে ‘পরমহংস’ জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে চোখে পড়েছিল সরস্বতীর ছোট্ট মুখ, ডান তীরে। গঙ্গা বা ভাগীরথী থেকে মুক্তির পর সপ্তগ্রাম হয়ে চন্দননগরের দিকে চলে গেছে।

ভারতের দুই ত্রিবেণিরই অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনটি নয়, দুটি নদী দৃশ্যমান। কল্যাণীতে গঙ্গা ও সরস্বতী দেখা গেলেও যমুনা নদীকে আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন। অবশ্য এই এলাকায় এসে মিশেছে কুন্তী নদী। কুন্তীই কি যমুনা? সহযাত্রী একজন বলেছিলেন, এখানেই গঙ্গা বা ভাগীরথীর সমান্তরালে যমুনা মিশে আছে। লক্ষ্য করেছিলাম, উজান ও ভাটির তুলনায় ভাগীরথী সেখানে বেশ চওড়া। ওদিকে যুক্তবেণিতে গঙ্গা-যমুনা দেখা গেলেও সরস্বতী অদৃশ্যমান। সেখানে কুম্ভস্নানে যাওয়া সাধুরা বিশ্বাস করেন, সরস্বতী নদী চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনায় সিদ্ধিলাভ হলেই কেবল নদীরূপী সরস্বতী দেখা দেন। অবশ্য প্রত্নবিদরা প্রাচীন সরস্বতীর রেখাও খুঁজে পাচ্ছেন।

বাংলাদেশের তিন সরস্বতী অবশ্য এখনও চর্মচক্ষে দৃশ্যমান। প্রথমটি আমাদের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাস্থল মেহেরপুরের মুজিবনগর ভিজিয়ে প্রবাহিত; ভৈরব ও জলাঙ্গি নদীকে যুক্ত করেছে। দুই প্রান্তেই সংযোগ হারিয়ে মৃতপ্রায় এ নদী স্থানীয়ভাবে ‘সরস্বতী খাল’ নামে পরিচিত। সর্বশেষ যখন নদীটিকে দেখেছি; কোথাও পুকুর কাটা, কোথাও গরু-ছাগল চড়ছে। দ্বিতীয় সরস্বতী বাঙালি নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রবাহিত সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা এলাকা দিয়ে করতোয়ায় মিশেছে। ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলমুখী মহাসড়কে ‘ফুড ভিলেজ’ রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে নদী অলিম্পিয়াডে যোগ দিতে রাজশাহী যাওয়ার পথে মধ্যাহ্নভোজন থেকে একটু সময় বাঁচিয়ে নদীটি ঘুরে দেখেছিলাম। এর পরিস্থিতিও মেহেরপুরের সরস্বতীর মতো; ক্ষীণকায়, স্থানীয়রা ‘খাল’ হিসেবে চেনেন। তৃতীয় সরস্বতী হবিগঞ্জের বানিয়াচঙে বলে জানিয়েছিলেন পরিবেশ সাংবাদিক পিনাকী রায়। নদীটি সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত জানি না।

গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর প্রসঙ্গই যখন এলো, আক্ষেপের কথা বলে রাখি। বাংলাদেশের গোয়ালন্দও কি ‘ত্রিবেণি’ হতে পারে না? কারণ, বাংলাদেশে গঙ্গা ও যমুনা মিলেছে গোয়ালন্দে এসে। আর সিরাজগঞ্জের যে সরস্বতী করতোয়ায় গিয়ে মিশেছে, সেটা গিয়ে শাহজাদপুরের কাছে যমুনায় মিশেছে। এলাহাবাদে বা কল্যাণীতে যদি দুই নদী মিলেই ত্রিবেণি হয়, গোয়ালন্দে তিন নদী মিলেই ত্রিবেণি হবে না কেন? যুক্ত ও মুক্ত বেণির পর এর নাম হতে পারে ‘বন্দিবেণি’। কারণ, গঙ্গা এরই মধ্যে ফারাক্কায় বন্দি নদী, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনাকেও বন্দি করতে চাইছে। আর সরস্বতী তো প্রায় নামই হারিয়ে ফেলতে বসেছে!

লক্ষ্মীর আরেকটি নাম পদ্মা, আমরা জানি। বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রবহমান এই প্রমত্তা নদী সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। নতুন করে কিছু বলার নেই। বাংলাদেশে বরং শিব নদী অনেকটা অপরিচিত। এই নদী আত্রাই থেকে উৎপন্ন হয়ে নওগাঁর মান্দা উপজেলা, রাজশাহীর তানোর, পবা হয়ে নাটোর জেলার মধ্য দিয়ে চলনবিলে পতিত হয়েছে। ১৯৬৫ সালের মান্দা উপজেলার বৈদ্যপুর এলাকায় নদীটির উৎসমুখে বাঁধ দেওয়ার ফলে এর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। শিবের রুদ্ররূপের নাম ‘ভৈরব’। পৌরাণিক বিশ্বাসমতে, শিব যেমন মহাপ্রলয় ঘটাতে পারেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভৈরবের গতিপথ যেন তেমন। ওই এলাকার যেদিকেই যাবেন, ভৈরবের কোনো না কোনো অংশ সামনে পড়বে। এত আঁকাবাঁকা! খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে শুধু সাতক্ষীরা ছাড়া বাকি ৯টি জেলাই এই নদির স্পর্শধন্য। ভৈরবের বর্তমান ধারা জলাঙ্গি থেকে উৎপন্ন হয়ে মেহেরপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর খুলনা শহরের কাছে রূপসায় মিলিত হয়েছে। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গে রেগুলেটর তৈরি করা হলে ভৈরব মরে যেতে থাকে।


কার্তিকের অপর নাম কুমার; এই নামে বাংলাদেশে অন্তত দুটি নদ রয়েছে। একটি প্রবাহিত বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে, অন্যটি বৃহত্তর যশোরে। দুর্গাপূজা মণ্ডপের আরেকটি প্রতিমা গণেশ নামে সরাসরি কোনো নদী নেই। নেত্রকোনায় রয়েছে গণেশ্বরী নদী। ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে উৎপন্ন এই নদী কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়ন দিয়ে প্রবেশ করে উপদাখালীতে মিশেছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, মহিষাসুরের নামেও একটি নদী রয়েছে বাংলাদেশ। নরসিংদী সদরের মহিষাসুরা ইউনিয়নে প্রবাহিত এই নদী একসময় শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করত। এখন বহুলাংশে শুকিয়ে গেছে। অবশ্য তিস্তা নদীর জন্মের পৌরাণিক কাহিনিতেও রয়েছে মহিষাসুরের ভূমিকা।

কেবল দেবদেবীর নামে নদী থাকার বিষয় নয়; দুর্গোৎসবের সঙ্গে রয়েছে নদীর নিবিড় সম্পর্ক। দেবী যেমন সাধারণ নদীতে বিসর্জিত হন, তেমনই দুর্গাপতি শিবের আবাস কৈলাস পর্বতে উপমহাদেশের প্রধান তিন নদীর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও সিন্ধুর উৎপত্তি; গঙ্গার উৎপত্তি অদূরের গঙ্গোত্রী হলেও এর প্রধান উপনদী ‘কার্নালি’ জন্মেছে কৈলাসেই। কথা হচ্ছে, নদীময় এই উৎসবে আমরা যেন নদী রক্ষার কথা ভুলে না যাই। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় পরিবেশকর্মী পীযূষ দাশের একটি স্লোগান দুর্গাপূজা এলেই আমার মনে পড়ে– ‘যে নদীতে তর্পণ, দেব-দেবী বিসর্জন, বাঁচান সেই নদীর জীবন।’ শেখ রোকন,  নদী-গবেষক [email protected]

আরও পড়ুন

×